সুনীল, তুমি একজন পৃষ্ঠপোষকের কথা বলছিলে। আমি কি অনুমান করতে পারি যে, মিঃ হিঙ্গোয়ানিই সেই পৃষ্ঠপোষক?
হিঙ্গোয়ানি চোখ কপালে তুলে চেয়ার থেকে প্রায় অর্ধেক উঠে পড়ে বললেন, বাট হাউ ডিড ইউ নো? এও কি ম্যাজিক?
না, মিঃ হিঙ্গোয়ানি, ম্যাজিক নয়। এ হচ্ছে ইন্দ্ৰিয়গুলিকে সজাগ রাখার ফল। আমরা গোয়েন্দারা সাধারণ লোকের চেয়ে একটু বেশি দেখি, বেশি শুনি।
কী দেখে বা শুনে আপনি এই তথ্যটা আবিষ্কার করলেন?
গত রবিবার তরফদারের ম্যাজিক শো-তে এক যুবকের প্রশ্নের উত্তরে এই জ্যোতিষ্ক দুটো গাড়ির নম্বর বলে দেয়। তার মধ্যে একটা নম্বর-ডব্লিউ এম. এফ ছয় দুই তিন দুই-দেখলাম। আপনার গ্যারাজের সামনে দাঁড়ানো কনটেসার নম্বর। এই যুরক কি আপনার বাড়ির লোক নন এবং তিনি শো থেকে ফিরে এসে কি আপনাকে জ্যোতিষ্কর আশ্চর্য ক্ষমতার কথা বলেননি?
ইয়েস, বলেছিল। মোহন, আমার ভাইপো… হিঙ্গোয়ানির কেমন যেন হতভম্ব ভাব।
আর একটা ব্যাপার আছে, বলল ফেলুদা! সেদিন আপনার ড্রইংরুমের বুক কেসে দেখলাম পুরো একটা তাকভর্তি ম্যাজিকের বই। তার মানে-
ইয়েস, ইয়েস, ইয়েস! ফেলুদাকে বাধা দিয়ে বললেন হিঙ্গোয়ানি। ওগুলোর মায়া আমি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। বাবা আমার ম্যাজিকের সব সরঞ্জাম ফেলে দিয়েছিলেন। কিন্তু বই ফেলেননি।
তরফদারের দিকে চেয়ে দেখি, তাঁর শোচনীয় অবস্থা।
তরফদারকে কোনও দোষ দেবেন না, মিঃ মিটার, বললেন হিঙ্গোয়ানি। ও আমারই অনুরোধে আমার নামটা প্রকাশ করেনি।
কিন্তু এই গোপনতার কারণ কী?
একটা বড় কারণ আছে, মিঃ মিটার।
কী
আমার বাবা এখনও জীবিত; ফৈজাবাদে থাকেন, আমাদের পৈতৃক বাড়িতে। ধিরাশি বছর বয়স। কিন্তু এখনও টনটনে জ্ঞান, মজবুত শরীর। তিনি যদি জানেন যে, এত দিন বাদে আমি আবার ম্যাজিকের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছি, তা হলে তিনি আমাকে ত্যাজ্যপুত্র করবেন।
ফেলুদা ভ্রূকুটি করে বার তিনেক মাথা উপর-নীচ করে বলল, বুঝেছি।
হিঙ্গোয়ানি বলে চললেন, মোহন শো দেখে ফিরে এসেই এই ছেলের অসামান্য ক্ষমতার কথা আমাকে বলে। তখনই আমার মাথায় আসে, আমি এই জাদুকরের শো ফাইনান্স করব। যখন থেকে তেওয়ারির সঙ্গে মন কষাকষি শুরু হয়েছে, তখন থেকেই বুঝতে পারছিলাম যে, আমাকে অবিলম্বে টি এইচ সিন্ডিকেটের পার্টনারশিপে ইস্তফা দিয়ে রোজগারের নতুন রাস্তা দেখতে হবে। রবিবার রাত্রে জ্যোতিষ্কর কথা শুনে সোমবার সকালেই আমি তরফদারের বাড়িতে গিয়ে আমার প্রস্তাবটা দিই। তরফদার রাজি হয়ে যায়। এর দুই দিন বাদেই তেওয়ারির টাকা-চুরি ধরা পড়ে এবং আমার সঙ্গে তার সংঘর্ষ সপ্তমে চড়ে। আমি আর থাকতে না পেরে তেওয়ারিকে একটা চার লাইনের চিঠিতে জানিয়ে দিই যে, আমি অসুস্থ। ডাক্তারের প্রস্তাব মতো এক মাসের অবসর নিচ্ছি। তার পরদিন থেকেই আমি আপিসে যাওয়া বন্ধ করি।
তার মানে আপনি এমনিতেই মাদ্রাজে আসছিলেন তরফদারের শোয়ের জন্য?
হ্যাঁ, কিন্তু আমার বিপদের আশঙ্কটাও সম্পূর্ণ সত্যি। অর্থাৎ আপনার সাহায্য আমাকে নিতেই হত।
আর আপনি মাদ্রাজে যে একটা চাকরির সম্ভাবনার কথা বলছিলেন?
সেটা সত্যি নয়।
আই সি! বলল ফেলুদা। তা হলে ব্যাপারটা যা দাঁড়াচ্ছে—আপনার জীবন বিপন্ন, যার কারণ হল তেওয়ারি সংক্রান্ত ঘটনা; আর জ্যোতিষ্কও ঘোর বিপদে পড়তে পারে দুজন অত্যন্ত লোভী আর বেপরোয়া ব্যক্তির চক্রান্তে। এই দুই বিপদই সামলানোর জন্য আমাকে নিযুক্ত করা হয়েছে। নয়নের সঙ্গে সব সময় আমাদের কেউ-না-কেউ থাকবে। এখন আপনি বলুন, আপনি কীভাবে আমাদের কাজটা সহজ করতে পারেন।
হিঙ্গোয়ানি বললেন, আমি কথা দিচ্ছি, আপনার আদেশ আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। মাদ্রাজে আমি এর আগে অনেক বার এসেছি। কাজেই এখানে আমার দেখবার কিছু বাকি নেই। তরফদারের শো এক বার শুরু হলে তার রিপোর্ট আমি ওর ম্যানেজারের কাছ থেকে পাব এবং শো-এর দরুন পেমেন্ট যা করার তা ম্যানেজারকেই করব। অর্থাৎ আমি ঘরেই থাকব এবং চেনা লোক কি না যাচাই না করে দরজা খুলব না।
ফেলুদা উঠে পড়ল, আর সেই সঙ্গে আমরা দুজনও।
এসো, নয়নবাবু।
জটায়ু নয়নের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন, নয়ন বেশ আগ্রহের সঙ্গে হাতটা ধরে নিল। বুঝলাম, জটায়ুকে তার বেশ পছন্দ হয়ে গেছে।
১০. স্নেক পার্কে
স্নেক পার্কে বেশিক্ষণ ছিলাম না, কিন্তু এটা বুঝেছি যে জায়গাটা একেবারে নতুন ধরনের। মাত্র একজন লোকের মাথা থেকে যে এ জিনিস বেরিয়েছে, সেটা বিশ্বাস করা যায় না। যত রকম সাপের নাম আমি শুনেছি তার সব, আর তার বাইরেও বেশ কিছু এই পার্কে রয়েছে। তা ছাড়া, সাপ দেখা ছাড়াও, পার্কে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দও এখানে পাওয়া যায়।
প্রথম দিনের এই আউটিং-এ কোনও উল্লেখযোগ্য বা চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেনি। যদিও হজসনের ছদ্মবেশের কথা জানার জন্যেই বোধ হয় দাড়িওয়ালা লোক দেখলেই জটায়ু বসাক বলে সন্দেহ করে নয়নকে একটু কাছে টেনে নিচ্ছিলেন।
সাপ দেখে এদিক-ওদিক ঘুরতে হঠাৎ দেখলাম, রেলিং দিয়ে ঘেরা একটা বেশ বড় জলা জায়গায় গোটা পাঁচেক কুমির রোদ পোয়াচ্ছে। দেখে মনে হল তারা সব কটাই ঘুমোচ্ছে। রেলিং-এর ফাঁক দিয়ে এ-দৃশ্য দেখছি, লালমোহনবাবু নয়নকে ফিসফিস করে বলছেন—তুমি আরেকটু বড় হলে তোমাকে আমার করাল কুভীর বইটা দেব—এমন সময় দেখি দু হাতে দুটো বালতি নিয়ে গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট পরা একটা লোক কুমিরগুলো থেকে হাত পঞ্চাশেক দূরে গিয়ে দাঁড়াল। কুমিরগুলো এবার একটু নড়েচড়ে উঠল। লোকটা এবার বালতিতে হাত ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে এক-একটা কোলা ব্যাঙ বার করে কুমিরগুলোর দিকে ছুড়ে ছুড়ে দিতে লাগল। আশ্চর্য এই যে, প্রত্যেকটা ব্যাঙই কোনও-না-কোনও কুমিরের হাঁ-করা মুখের ভিতর গিয়ে পড়ল। কুমিরকে ব্যাঙ চিবিয়ে খেতে আর কোনওদিন দেখিওনি আর দেখব বলে ভাবিওনি।