নীচে পৌঁছে। একজন বেয়ারাকে সামনে পেয়ে ফেলুদা জিজ্ঞেস করল, হায়্যার ইজ দ্য কনফারেন্স রুম?
বেয়ারা দেখিয়ে দিল, আমরা হুড়মুড়িয়ে গিয়ে ঘরে ঢুকলাম।
বেশ বড় ঘর। তার মাঝখানে লম্বা টেবিলের দুপাশে আর দু মাথায় সারি সারি চেয়ার। একটা চেয়ারে নয়ন বসে আছে, তার পাশের চেয়ারে একজন দাঁড়িওয়ালা লোক নোটবই খুলে ডট পেন হাতে নিয়ে নয়নের সঙ্গে কথা বলছে।
ফেলুদা তিন সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখল। তারপর ঝড়ের বেগে এগিয়ে গিয়ে এক টানে রিপোর্টারের গাল থেকে দাড়ি, আর আরেক টানে ঠোঁটের উপর থেকে গোঁফ খুলে ফেলল।
অবাক হয়ে দেখলাম ছদ্মবেশের তলা থেকে বেরিয়ে পড়েছেন হেনরি হজসন।
গুড মর্নিং! উঠে দাঁড়িয়ে নির্লজ্জ হাসি হেসে বললেন হজসন।
ফেলুদা নয়নের দিকে ফিরল।
উনি কী জিজ্ঞেস করছিলেন তোমাকে?
ঘোড়ার কথা।
আমার কাজ এখানে শেষ হলেও আমার আপশোস নেই, বললেন। হজসন। আগামী তিন দিনের সব কটা রেসের উইনিং হর্সের নম্বর আমি জেনে নিয়েছি। আমি এখন বেশ কয়েক বছরের জন্য নিশ্চিন্ত। গুড ডে স্যার
হজসন গটগটিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। ফেলুদা কপালে হাত দিয়ে ধাপ করে হজসনের চেয়ারে বসে পড়ল। তারপর মাথা নেড়ে গভীর বিরক্তির সুরে বলল, নয়ন, এবার থেকে কোনও বাইরের লোক তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তুমি বলবে–ফেলুকাক সঙ্গে থাকলে বলব, না হলে নয়। বুঝেছ?
নয়ন মাথা নেড়ে জানিয়ে দিল সে বুঝেছে।
আমি বললাম, তবে একটা কথা ফেলুদা—হজসন আর জ্বালাবে না; সে এখন কলকাতায় ফিরে গিয়ে রেস খেলবে।
সেটা ঠিক, কিন্তু আমি ভাবছি আমাদের জাদুকরটি কত দায়িত্বজ্ঞানহীন। ম্যাজিশিয়ানদের এর চেয়ে বেশি কমনসেন্স থাকা উচিত।
আমরা নয়নকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে গেলাম তরফদারের ঘরে।
চমৎকার পাবলিসিটি হবে তোমার। শ্লেষ-মাখানো সুরে তরফদারকে বলল ফেলুদা।
নয়ন কাকে ইন্টারভিউ দিচ্ছিল, জানো?
কাকে?
মিস্টার হেনরি হজসন।
ওই দাড়িওয়ালা–?
হ্যাঁ, ওই দাড়িওয়ালা। তার কার্যসিদ্ধি হয়ে গেছে। এই যদি তোমার আক্কেলের নমুনা হয়, তা হলে কিন্তু আমি তোমাকে কোনওরকম সাহায্য করতে পারব না। তোমার অনুমান যে ভুল সে তো দেখতেই পাচ্ছ; হজসন যদি ম্যাড্রস অবধি ধাওয়া করতে পারে, তা হলে অন্য দুজনই বা করবে না কেন? আমি জানি যে বিপদের আশঙ্কা এখনও পুরো মাত্রায় রয়েছে। এ অবস্থায় আমি যা বলছি, তা তোমাকে মানতেই হবে।
বলুন স্যার, হেঁট মাথা চুলকে বললেন তরফদার।
মিঃ রেডির তরফ থেকে যেটুকু পাবলিসিটি না করলেই নয়, সেটুকু তিনি করবেন; কিন্তু তোমরা—তুমি বা শঙ্কর পাবলিসিটির ধারে-কাছেও যাবে না। প্রেস পীড়াপীড়ি করলেও তাদের কাছে তোমরা মুখ খুলবে না। তোমার এই সফর যদি সাকসেসফুল হয়, তা হলে সেটা হবে নয়নের জোরে, তোমাদের পাবলিসিটির জোরে নয়। বুঝেছ?
বুঝেছি স্যার।
ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে লালমোহনবাবুকে ঘটনাটা বলতে উনি বললেন, ঠিক এইটেরই দরকার ছিল। ভয় হচ্ছিল যে, মাদ্রাজে এসে বুঝি কেসটা থিতিয়ে যাবে। তা নয়-এখন আবার দিব্যি। জমে উঠেছে।
ঠিক হয়েছিল দশটার সময় আমরা দুটো ট্যাক্সি নিয়ে বেরোব। মহাবলীপুরম আজ নয়, কাল। আজ যাব স্নেক পার্ক দেখতে। হুইটেকার নামে এক আমেরিকানের কীর্তি এই স্নেক পার্ক। গাছপালায় ভরা পার্কও বটে, আবার সেই সঙ্গে সাপের ডিপো ও বটে।
যাবার জন্য তৈরি হচ্ছি, লালমোহনবাবু অলরেডি তৈরি হয়ে আমাদের ঘরে এসে হাজির, এমন সময় দরজার বেল বেজে উঠল। দরজা খুলে দেখি মিঃ হিঙ্গোয়ানি।
মে আই কাম ইন?
টি ভি-টা খোলা ছিল, যদিও দেখবার মতো কিছুই হচ্ছিল না, ফেলুদা সেটা বন্ধ করে দিয়ে বলল, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই—প্লিজ কাম ইন।
ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে কাউচে বসে বললেন, সো ফার—নো ট্রাবল।
এ তো সুসংবাদ, বলল ফেলুদা।
আমার বিশ্বাস তেওয়ারি আমার ম্যাড্রাসে আসার খবরটা জানে না। আমি কাউকে না। বলে চলে এসেছি।
আপনি নিজে সাবধানে আছেন তো?
তা আছি।
একটা কথা আমি খুব জোর দিয়ে বলছি—আপনি যখন ঘরে থাকবেন, তখন কেউ বেল টিপলে আপনি নাম জিজ্ঞেস করে গলা চিনে, তার পর দরজা খুলবেন, তার আগে নয়।
হিঙ্গোয়ানি কিছু বলার আগেই আমাদের দরজার বেল বেজে উঠল। খুলে দেখি, নয়নকে নিয়ে তরফদার হাজির।
এসো ভিতরে, বলল ফেলুদা।
এই সেই অদ্ভুত ক্ষমতাসম্পন্ন বালক কি? দুজনে ঘরে ঢুকতে জিজ্ঞেস করলেন হিঙ্গোয়ানি।
ফেলুদার দিকে চেয়ে দেখি তার ঠোঁটের কোণে হাসি।
আপনার সঙ্গে এই দুজনের পরিচয় করিয়ে দেবার কোনও প্রয়োজন আছে কি? হিঙ্গোয়ানিকে প্রশ্ন করল ফেলুদা।
হোয়াট ডু ইউ মিন?
মিঃ হিঙ্গোয়ানি, আপনি আমাকে আপনার নিরাপত্তার জন্য নিযুক্ত করেছেন। এখানে আপনাকে মনে রাখতে হবে যে গোয়েন্দার কাছ থেকে মক্কেল যদি কোনও জরুরি তথ্য গোপন করেন তা হলে গোয়েন্দার কাজটা আরও অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়ে।
আপনি কী বলতে চাইছেন?
সেটাও আপনি খুব ভাল করেই জানেন, কিন্তু না-জানার ভাণ করছেন। অবিশ্যি সত্য গোপন করার অভিযোগ শুধু আপনার বিরুদ্ধেই প্রযোজ্য নয়। এর বিরুদ্ধেও বটে।
ফেলুদা শেষ কথাটা তরফদারকে উদ্দেশ করে বলল; তরফদার কিছু বলতে না পেরে ফ্যালি-ফ্যাল করে চেয়ে রইল।
আপনারা যখন মুখ খুলছেন না, তখন আমিই বলি।
ফেলুদার দৃষ্টি এখনও তরফদারের দিকে।