তা ছাড়া তো উপায় নেই। প্লেনের সিটে তো গাওয়াঙ্গি বসতেই পারবে না!
আরেক দফা হো হো করে হেসে ভদ্রলোক উঠে পড়ে বললেন, আপনাকে একটা কথা বলি মিঃ মিত্তির-এমন অনেক সিচুয়েশান আছে, যেখানে শারীরিক শক্তির কাছে মানসিক শক্তি দাঁড়াতেই পারে না। গাওয়াঙ্গির চেয়ে আপনার বুদ্ধি যে অনেক গুণে বেশি তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু আপনার ব্যায়ামের অভ্যাস থাকলেও, গাওয়াঙ্গিয় যে শারীরিক বল, তার শতাংশের একাংশও আপনার নেই। –গুড বাই।
ভদ্রলোক যেমন হঠাৎ এসেছিলেন, তেমনই হঠাৎ চলে গেলেন। আমি মনে মনে বললাম-এই গাওয়াঙ্গি বস্তুটিকে একবার চাক্ষুষ দেখতেই হবে।
০৯. স্টেশন থেকে হোটেলে
স্টেশন থেকে হোটেলে আসার পথে মাদ্রাজের চেহারা দেখে জটায়ু বললেন, মশাই, এই শহরের নাম কলকাতা রাম্বে দিল্লির সঙ্গে একসঙ্গে উচ্চারণ করা হয় কেন তার কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। পশ্চিমবাংলার যে কোনও মফস্বল টাউন এর চেয়ে বেশি গমগমে। তা ছাড়া ডিসেম্বর মাসে গরমটা কী রকম দেখেছেন? আর ইয়ে—আমরা যে-হোটেলে যাচ্ছি, সেখানে দিশি বিদেশি সব রকম খাবার পাওয়া যায় তো? মাদ্রাজি মেনুতে শুনিচি শুধু তিনটে নাম থাকে। আমি খাইয়ে না হতে পারি, কিন্তু যা খাব, সেটা মুখরোচক না হলে আমার সাধ মেটে না।
আমার কিন্তু শহরটা খারাপ লাগছিল না, যদিও গামাগমে ভগবটা একেবারেই নেই। অনেক দিন পরে একটা বড় শহরে এসে চারিদিকে চ্যাঙ চ্যাঙ বাড়ির ভিড় নেই দেখে অদ্ভুত লাগছিল। রাস্তা দিব্যি ভাল—এখন পর্যন্ত গাড়িড়াও পাইনি। আর যেটা পাইনি সেটা হল ট্র্যাফিক জ্যাম। তা সত্ত্বেও লালমোহনবাবু কেন মুখ বেজার করে আছেন জানি না।
বৈকুণ্ঠ মল্লিকের কথা তো কয়েক বার বলিটি আপনাদের, হঠাৎ বললেন জটায়ু।
আপনার সেই এথিনিয়াম ইনস্টিটিউশনের কবি?
কবি অ্যান্ড পর্যটক। শ্রমণের নেশা ছিল ভদ্রলোকের।
উনি কি মাদ্রাজেও এসেছিলেন?
সার্টেনলি।
মাদ্রাজ নিয়ে পদ্য আছে, ওঁর?
সার্টেনলি! জাস্ট সিক্স লাইনস। শুনুন–
বড়ই হতাশ হয়েছি আজ।
তোমারে হেরিয়ে মাদ্রাজ!–
ভাষা হেথা দুবোধ্য তামিল
অন্য ভাষার সাথে নেই কোনও মিল–
ইডলি আর দোসা খেয়ে তৃপ্তিবে রসনা?
ওরে বাবা, এ শহরে কেউ কভু এস না!
তৃপ্তিবে? ভুরু কুঁচকে বলল ফেলুদা।
হোয়াই নট? মল্লিকের উপর মাইকেলের দস্তুর মতো প্রভাব ছিল। তৃপ্তিবে হল নামধাতু। আপনি গোয়েন্দা তাই হয়তো জানেন না; আমরা সাহিত্যিকরা জানি। বলছি না-হাইলি ট্যালেন্টেড। পোড়া দেশ বলে কলকে পেলেন না।
আমি দেখেছি বৈকুণ্ঠ মল্লিকের কথা বলতে গেলেই জটায়ু ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েন, আর এতটুকু সমালোচনা করলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন। আমি আর ফেলুদা তাই চুপ মেরে গোলাম।
এই ফাঁকে বলে রাখি যে, ট্রেনে কোনও গণ্ডগোল হয়নি। তরফদার, শঙ্করবাবু আর নয়ন এ সি ফাস্ট ক্লাসে আমাদের এক বাগিতেই ছিলেন। দলের বাদবাকি সব ছিল সেকেন্ড ক্লাসে। যে তিনজনকে নিয়ে চিন্তা—হজসন, তারকনাথ আর বসাক—তারা কেউ এ ট্রেনে এসে থাকলেও আমাদের সঙ্গে দেখা হয়নি। ম্যাড্রাস সেন্ট্রালে নেমেও এদের কাউকে দেখিনি। হিঙ্গোয়ানি আজ রাত্রেই প্লেনে আসছেন, আর আমাদের হোটেলেই থাকবেন।
করোমণ্ডলের ঝলমলে লবিতে ঢুকে লালমোহনবাবুর মুখে প্রথম হাসি দেখা দিল। এ দিকে ও দিকে দেখে বললেন, নাঃ, অনবদ্যু মশাই অনবদ্য! ইন্ডলি-দোসার দেশে এ জিনিস ভাবাই যায় না।
ট্রেনেই আলোচনা করে ঠিক হয়েছে যে আমরা প্রথম তিনটে দিন একটু ঘুরে দেখব। সঙ্গে অবশ্য নয়ন আর তরফদারও থাকবে। ফেলুদা বলেছে-আমরা এলিফ্যান্টা দেখেছি, এলোরা দেখেছি, উড়িষ্যার মন্দির দেখেছি। –মাদ্রাজে এসে মহাবলীপুরম দেখলে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্যের নমুনাটা দেখা হয়ে যাবে। তোপ্সে, তুই গাইডবুকটায় একটু চোখ বুলিয়ে নিস। কতগুলো তথ্য জানা থাকলে দেখতে আরও ভাল লাগবে।
রাত্রে নটার মধ্যে ডাইনিং রুমে গিয়ে মোগলাই খান খেয়ে ঠাণ্ডা ঘরে দিব্যি আরামে ঘুম দিলাম। পরদিন সকালে উঠে ফেলুদা বলল, এক বার তরফদারের খোঁজটা নেওয়া দরকার।
আমরা দুজন আমাদের চার তলার ৪৩৩ নম্বর ঘর থেকে তিন তলার ৩৮২ নম্বর ঘরের সামনে গিয়ে দরজার বেল টিপলাম।
দরজা খুলে দিলেন তরফদার নিজেই। ঘরে ঢুকে দেখি শঙ্করবাবুও রয়েছেন, আর আরেকটি ভদ্রলোক, যাকে দেখলেই মাদ্রাজি বলে বোঝা যায়। কিন্তু নয়নকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?
গুড মার্নিং মিঃ মিত্তির, একগাল হেসে বললেন তরফদার-ইনি মিঃ রেডি। এর রোহিণী থিয়েটারেই আমার শো। বলছেন প্রচুর এনকোয়ারি আসছে। এর ধারণা, দুর্দান্ত সেল হবে।
নয়ন কই? তরফদারের কথাগুলো যেন অগ্রাহ্য করেই জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
এখানকার সবচেয়ে নামী কাগজ হিন্দু-র একজন রিপোর্টার নয়নকে ইন্টারভিউ করছে? বললেন তরফদার। এর ফলে আমাদের দারুণ পাবলিসিটি হবে।
কিন্তু কোথায় হচ্ছে সেই ইন্টারভিউ?
হোটেলের ম্যানেজার নিজে একতলার কনফারেন্স রুমে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এও বলা আছে বাইরের কাউকে যেন ঢুকতে না দেওয়া হয়। তা ছাড়া—
তরফদাবের কথা শেষ হবার আগেই ফেলুদা এক লাফে ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড় দিল। হোটেলের করিডর দিয়ে—আমি পিছনে।
লিফুট না নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উৰ্ধৰ্বশ্বাসে নামলাম আমরা-ফেলুদা সমানে দাঁতে দাঁত চেপে হিন্দি, ইংব্রিজি ও বাংলায় তরফদারের উদ্দেশে গালি দিয়ে চলেছে।