উনি যে ক্লেম করেন যে এককালে আপনাকে কম্বিনেশনটা বলেছিলেন, সেটা কি সত্যি?
সর্বৈব মিথ্যা। ওটা ছিল ওর পাসোনাল সিন্দুক। তার কম্বিনেশন ও পাঁচজনকে বলে বেড়াবে? ননসেন্স। তা ছাড়া ওর ধারণা যে ও যখন ডেনটিস্টের কাছে যায়। তখনই আমি ওর সিন্দুক খুলে টাকা চুরি করি। অথচ আমার অকাট্য প্রমাণ রয়েছে যে সেই সময়টা আমি ছিলাম আপিস থেকে অন্তত চার মাইল দূরে। আমার এক খুড়তুতো ভাইয়ের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে খবর পেয়ে আমি এগারেটার সময় কেলভিউ ক্লিনিকে চলে যাই, ফিরি সাড়ে তিনটেয়।
তাও মিঃ তেওয়ারি আপনার পিছনে লেগে আছেন?
শুধু পিছনে লেগেছেন নয় মিস্টার মিটার, তিনি আমাকে শাসিয়েছেন যে অবিলম্বে টাকা ফেরত না দিলে তিনি আমার সর্বনাশ করবেন। তেওয়ারি যে স্বার্থসিদ্ধির জন্য কতদূর যেতে পারে তার বেশ কিছু নমুনা আমি গত সতেরো বছরে পেয়েছি। গুণ্ডা লাগিয়ে কী করা সম্ভব-অসম্ভব সে আর আমি আপনাকে কী বলব?
আপনি বলতে চান তেওয়ারি এতই প্রতিহিংসাপরায়ণ যে গুণ্ডা লাগিয়ে আপনাকে খুন করানোতেও সে পেছপা হবে না?
সিন্দুকে কিছু নেই জানার পরমুহূর্তে সে যেভাবে আমার ঘরে এসে আমার উপর দোষারোপ করে, তাতে আমি পরিষ্কার বুঝি যে তার কাণ্ডজ্ঞান সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে। এ অবস্থায় টাকা ফেরত না পেলে আমার উপর চরম প্রতিশোধ নেওয়াটা কিছুই আশ্চর্য নয়।
এই চুরি সম্বন্ধে আপনার নিজের কোনও থিওরি আছে?
প্রথমত, চুরি যে গেছে সেটাই আমি বিশ্বাস করি না। তেওয়ারি হয় সেটা সরিয়েছে, না হয় কিছুতে খরচ করেছে, না হয় কাউকে দিয়েছে; তোমরা বাংলায় যে বলে না। –ব্যোম ভোলানাথ?—তেওয়ারি হল সেই ভোলানাথ। না হলে বাইশ বছরের পুরনো ব্যক্তিগত সিন্দুদের কম্বিনেশন কেউ ভোলে?
বুঝলাম, বলল ফেলুদা। এবার তা হলে আসল কথায় আসা যাক।
কেন আমি আপনাকে ডেকেছি সেটা জানতে চাইছেন তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
দেখুন। মিঃ মিটার—আমি চাই প্রোটেকশন। তেওয়ারি নিজে ভোলানাথ হতে পারে, কিন্তু ভাড়াটে গুণ্ডাদের কেউই ভোলানাথ নয়। তারা অত্যন্ত সেয়ানা, ধূর্ত, বেপরোয়। এই জাতীয় প্রোটেকশনের কাজ তো আপনাদের প্রাইভেট ডিটেকটিভদের মধ্যে পড়ে। তাই না?
তা পড়ে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে কী, আমি সামনে প্ৰায় পাঁচ সপ্তাহের জন্য থাকছি। না। ফলে আমার কাজ শুরু করতে তো অনেক দেরি হয়ে যাবে। তাতে আপনার চলবে কি?
আপনি কোথায় যাচ্ছেন?
দক্ষিণ ভারত। প্রথমে ম্যাড্রাস। সেখানে দশ দিন, তারপর অন্যত্র।
হিঙ্গোয়ানির চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।
এক্সেলেন্ট! হাঁটুতে চাপড় মেরে বললেন ভদ্রলোক। আপনাকে একটা কথা এখনও বলা হয়নি-আমি দুদিন থেকে আর আপিসে যাচ্ছি না। যা ঘটেছে তার পরে আর কোনও মতেই ওখানে থাকা যায় না। আইনত যা করার তা আমি যথাসময়ে করব। –যখন মাথা ঠাণ্ডা হবে। অথচ রোজগার তো করতেই হবে। ম্যাড্রাসে একটা কাজের সম্ভাবনা আছে সে খবর আমি পেয়েছি। আমি এমনিতেই যেতম। আপনারা গেলে একসঙ্গেই বেরিয়ে পড়ব। আপনি প্লেনে যাচ্ছেন?
না, ট্রেনে। এখানেও একজনকে প্রোটেক্ট করার ব্যাপার আছে; তরফদারের ম্যাজিক শোয়ের ওই বালক। তারও জীবন বিপন্ন। অন্তত তিনজন ব্যক্তির লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে ওর উপর। বুঝতেই তো পারছেন, এমন আশ্চর্য ক্ষমতাকে অসদুদ্দেশ্যে কাজে লাগানোর অজস্র উপায় আছে।
বেশ তো, বললেন হিঙ্গোয়নি, আপনি এক ঢিলে দুই পাখি মারুন। আপনি তো এই জাদুকরের জন্য প্রোফেশনালি কাজ করছেন?
হ্যাঁ।
ফেলুদা অফারটা নিয়ে নিল। তবে বলল, এটা জেনে রাখবেন যে, শুধু আমার প্রোটেকশনে হবে না। আপনাকেও খুব সাবধানে চলতে হবে। আর সন্দেহজনক কিছু হলেই আমাকে জানাবেন।
নিশ্চয়ই। আপনি কোথায় থাকবেন?
হোটেল করোমণ্ডল। আমরা একুশে পৌঁছচ্ছি।
বেশ। ম্যাড্রাসেই দেখা হবে।
বাড়ি ফেরার পথে আমি বললাম,আচ্ছ ফেলুদা, ড্রইং রুমের দুদিকের দেয়ালে দুটো বেশ বড় বড় রেক্টাঙ্গুলার ছাপ দেখলাম। –অনেক দিনের টাঙানো ছবি তুলে ফেললে যেমন হয়।
গুড অবজারভেশন, বলল ফেলুদা। বোঝাই যাচ্ছে ও জায়গায় দুটো বাঁধানো ছবি ছিল–সম্ভবত অয়েল পেন্টিং।
সেগুলো যে আর নেই, বললেন জটায়ু, সেটার কোনও সিগনিফিক্যান্স আছে কি?
বোঝাই যাচ্ছে ভদ্রলোক ছবিগুলো পাচার করে দিয়েছেন।
তার সিগনিফিক্যান্স?
সাতশো ছেষট্টি রকম সিগনিফিক্যান্স। সব শোনার সময় আছে কি আপনার?
আবার সজারু!-আমার মনে হয় ব্যাপারটাকে আপনি বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
সেটার সময় এখনও আসেনি, লালমোহনবাবু! তথ্যটা আমার মস্তিষ্কের কম্পিউটারের মেমরিতে পুরে দিয়েছি। প্রয়োজনে বোতাম টিপলেই ফিরে পাব।
আপনি যে এই হিঙের কচুরির কেসটাও নিলেন—দুদিক সামলাতে পারবেন তো?
ফেলুদা কোনও উত্তর না দিয়ে ভাসা-ভাসা চোখে চলন্ত গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে থেকে মৃদুস্বরে বলল, খট্কা…খট্কা…খাটুকা…
০৮. ভারত সফর
পরদিন সকালে কাগজ খুলে দেখি, তরফদার সম্বন্ধে খবর বেরিয়েছে যে উনি উনিশে ডিসেম্বর দলবল নিয়ে দক্ষিণ ভারত সফরে যাচ্ছেন, পঁচিশে ডিসেম্বর ম্যাড্রাসে ওঁর প্রথম শো।
ফেলুদা চুল ছাঁটতে গিয়েছিল, দশটা নাগাত ফিরল। ওকে খবরটার কথা বলতে ও গম্ভীরভাবে বলল, দেখেছি। .. আত্মপ্রচারের লোভ খুব কম লোকেই সামলাতে পারে রে, তোপ্সে! আমি একটু নরম-গরম কথা শোনাব বলে ওকে ফোন করেছিলাম, কারণ—বুঝতেই তো পারছিস—এই খবর বেরোনোর ফলে আমার কাজটা অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়ছে।