আলিপুর পার্ক রোড।
বনেদি পাড়া।
—আমরাও যাচ্ছি। তো আপনার সঙ্গে?
সেটা কবে যাননি বলতে পারেন?
ঠিক কথা। ইয়ে-আনি দিয়ে পদবি শেষ হলে তো সিন্ধি বোঝায়, তাই না?
তা তো বটেই। দেখুন না—দু আনি ছি আনি কেরানি কাঁপানি হাঁপানি চাকরানি মেথরানি…
রক্ষে করুন, রক্ষে করুন! দু হাত তুলে বললেন জটায়ু। বাপরে!—এ হচ্ছে আপনার সজারু-মজারু মুড়। আমার খুব চেনা। কিছু জিজ্ঞেস করলেই টিটকিরির খোঁচা। যাই হোক-যেটা বলতে চাইছিলাম-ভাবছি আজ দ্বিপ্রহরের আহারটা এখানেই সারব। খিচুড়ির আইডিয়াটা কেমন লাগে? বেশ ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা পড়েছে তো?
উত্তম প্রস্তাব, বলল ফেলুদা।
দুপুরে খাবার পর ফেলুদা দু ঘণ্টা ধরে জটায়ুকে স্ক্র্যাকূল খেলা শেখাল। ভদ্রলোক কোনও দিন ক্রসওয়ার্ডই করেননি। তাই ওঁকে-সিন্ধি নামের ঢঙেই বুলি। –বেশ নাকানি-চোবানি খেতে হল। ফেলুদা শব্দের খেলাতে একেবারে মাস্টার, যেমন হেঁয়ালির জট ছাড়াতেও মাস্টার-যার অনেক উদাহরণ এর আগে দিয়েছি।
আলিপুর পার্ক রোড অবশ্যই হরিপদবাবুর চেনা। পাঁচটা বাজতে পাঁচ মিনিটে আমাদের গাড়ি সাঁইত্রিশ নম্বরের গেট দিয়ে ঢুকে পোর্টিকের নীচে এসে থামল। সামনেই ডাইনে গ্যারেজ, তার বাইরে একটা লম্বা সাদা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বিদেশি বলে মনে হচ্ছে? লালমোহনবাবু মন্তব্য করলেন।
ফেলুদা সদর দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, না। ওটার নাম কনটেসা। এখানেই তৈরি।
সদর দরজায় দারোয়ান দাঁড়িয়ে, ফেলুদা তাকে বলল, আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
ইতিমধ্যে বোধহয় গাড়ির শব্দ পেয়েই একটি বেয়ারা এসে হাজির হয়েছে; সে লালমোহনবাবুর দিকে চেয়ে বলল, মিত্তর সাব?
হাম নেহি-ইনি, ফেলুদার দিকে দেখিয়ে বললেন জটায়ু।
আইয়ে আপ লোগ।
বেয়ারার পিছন পিছন আমরা একটা ড্রইং রুমে গিয়ে হাজির হলাম।
বৈঠিয়ে।
আমি আর জটায়ু একটা সোফায় বসলাম! ফেলুদা তৎক্ষণাৎ না বসে একটু এদিক-ওদিক ঘুরে দেখে একটা বুক সেলফের সামনে গিয়ে দাঁড়াল; দেওয়ালে আর টেবিলে শোভা পাচ্ছে এমন খুঁটিনাটির মধ্যে অনেক নেপালি জিনিস রয়েছে। লালমোহনবাবুও দেখেছেন, কারণ বিড়বিড় করে বলতে শুনলাম, দার্জিলিং।
কেন, দার্জিলিং কেন? ফিরে এসে আরেকটা সোফায় বসে বলল ফেলুদা। নেপালি জিনিস কি নেপালে পাওয়া যায় না?
আরো সে তো নিউ মার্কেটেই পাওয়া যায়।
বাইরে ল্যান্ডিং-এ দাঁড়ানো গ্র্যান্ডফাদার ক্লিক দেখেছি, এবার তাতে গভীর অথচ মোল্যায়েম শব্দে ঢং ঢেং করে পাঁচটা বাজতে শুনলাম। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে খয়েরি রঙের সুট পরা একজন রোগা, ফরাসা, প্রৌঢ় ভদ্রলোক ঘরে এসে ঢুকলেন। কেন জানি মনে হল ভদ্রলোকের স্বাস্থ্যটা খুব ভাল যাচ্ছে না-বাধহয় চোখের তলায় কালির জন্য।
আমরা তিনজনেই নমস্কার করতে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে বললেন, বসুন বসুন-প্লিজ সিট ডাউন।
ভদ্রলোকের ঘড়ির ব্যান্ডটা বোধহয় ঢিলে হয়ে গেছে, কারণ নমস্কার করে হাত নামাবার সঙ্গে সঙ্গে ঘড়িটা সাড়াৎ করে নীচে নেমে এল। ডান হাত দিয়ে ঠেলে সেটাকে যথাস্থানে এনে ভদ্রলোক ফেলুদার উলটাদিকের সোফায় বসলেন। বাংলা ইংরেজি হিন্দি মিশিয়ে কথা বললেন হিঙ্গেয়ানি।
ফেলুদা নিজের এবং আমাদের দুজনের পরিচয় করিয়ে দেবার পর ভদ্রলোক বললেন, আমার আপিসের যে খবর কাগজে বেরিয়েছে সে কি আপনি পড়েছেন?
পড়েছি, বলল ফেলুদা।
আমি গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাবে বিশ্বাস করি। আমাকে যে ভাবে হ্যাঁরাস করা হচ্ছে তাকে গ্রহের ফের ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। আমার পার্টনারের ভীমরতি ধরেছে; কোনও সুস্থ মস্তিষ্ক লোক কখনও এমন করতে পারে না।
আমরা কিন্তু আপনার পার্টনারকে চিনি।
হাউ? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন হিঙ্গোয়ানি।
ফেলুদা সংক্ষেপে তরফদার আর জ্যোতিষ্কের ব্যাপারটা বলে বলল, এই ছেলের ব্যাপারেই তেওয়ারি ফোনে অ্যাপিয়েন্টমেন্ট করে তরফদারের বাড়ি এসেছিলেন। আমরা তখন সেখানে উপস্থিত ছিলাম। ভদ্রলোক বললেন তাঁর সিন্দুকের কম্বিনেশনটা ভুলে গেছেন। ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করাতে সে বলে দেয়, আর সেই সঙ্গে এটাও বলে যে সিন্দুকে আর একটি পাই-পয়সাও নেই।
আই সি…
আপনি ফোনে বললেন আপনাকে খুব বিব্রত হতে হচ্ছে?
তা তো বটেই। প্রথমত, বছর খানেক থেকেই আমাদের মধ্যে বনিব্বনা হচ্ছে না, যদিও এককালে আমরা বন্ধু ছিলাম। আমরা একসঙ্গে এক ক্লাসে সেন্ট জেভিয়ার্সে পড়তাম। কলেজ ছাড়ার বছর খানেকের মধ্যেই আমরা আলাদা আলাদা ভাবে ব্যবসা শুরু কবি। তারপর ১৯৭৩-এ আমরা এক জোটে টি এইচ সিন্ডিকেটের পত্তন করি। বেশ ভাল চলছিল কিন্তু ওই যে বললাম–কিছুদিন থেকে দুজনের সম্পর্কে চিড় ধরেছিল।
সেটার কারণ কী?
প্রধান কারণ হচ্ছে—তেওয়ারির স্মরণশক্তি প্ৰায় লোপ পেতে বসেছিল। সামান্য জিনিসও মনে রাখতে পারে না। ওকে নিয়ে মিটিং করা এক দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গত বছর একদিন আমি তেওয়ারিকে বলি-ডাঃ শৰ্মা বলে একজন অত্যন্ত বিচক্ষণ মস্তিষ্ক চিকিৎসক আছেন। তাঁকে আমি খুব ভাল করে চিনি; আমি চাই তুমি একবার তাঁর কাছে যাও। –তাতে তেওয়ারি ভয়ানক অফেন্স নেয়। সেই থেকেই আমাদের সম্পর্কে চিড় ধরে। অথচ আমি হাল না ধরলে সিন্ডিকেট ডুবে যাবে শুধু এই কথা ভেবেই আমি রয়ে গিয়েছিলাম। না হলে আইনসম্মত ভাবে পাির্টনারশিপ চুকিয়ে দিয়ে চলে আসতাম। কিন্তু যে ব্যাপারে আমি সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেলাম সেটা এই যে, তেওয়ারি যেই জানতে পারল যে ওর সিন্দুক খালি, ও সটান আমার কাছে এসে বলল, গিভ মি ব্যাক মাই মানি–দিস মিনিট।