আমাদের কাজ শেষ, আমরা ভদ্রলোককে বেশ ভাল রকম ধন্যবাদ দিয়ে বাড়িমুখে রওনা দিলাম।
শ্ৰীনাথ দরজা খুলে দিতে বসবার ঘরে ঢুকেই দেখি দুজন ভদ্রলোক বসে আছেন। তার মধ্যে সুনীল তরফদারকে চিনি। অন্যজনকে আগে দেখিনি।
ফেলুদা ব্যস্তভাবে বলল, সরি। তোমরা কি অনেকক্ষণ এসেছ?
পাঁচ মিনিট, বললেন তরফদার। এ হচ্ছে আমার ম্যানেজার ও প্রধান সহকারী—শঙ্কর হুবলিকার।
আপনি তো মারাঠি? প্রশ্ন করল ফেলুদা।
ইয়েস স্যার। তবে আমার জন্ম, স্কুলিং, সবই এখানে।
বসুন, বসুন।
আমরা সবাই বসলাম।
কী ব্যাপার বলে? তরফদারকে উদ্দেশ করে বলল ফেলুদা।
ব্যাপার গুরুতর।
মানে?
কাল আমাদের বাড়িতে দৈত্যের আগমন হয়েছিল।
আমার বুকটা ধড়াস করে উঠল। সেই গাওয়াঙ্গির কথা বলছেন নাকি ভদ্রলোক?
ব্যাপারটা খুলে বলো, বলল ফেলুদা।
বলছি। বললেন ভদ্রলোক। আজি ঘুম থেকে উঠে বাদশাকে নিয়ে হাঁটতে বেরোব—তখন সাড়ে পাঁচটা—দোতলা থেকে নেমেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
কেন?
সিঁড়ির সামনের মেঝেতে ছড়িয়ে আছে। রক্ত, আর সেই রক্ত থেকে পায়ের ছাপ সদর দরজার দিকে চলে গেছে। সেই ছাপ পরে মেপে দেখেছি-লম্বায় ষোল ইঞ্চি।
ষো…! লালমোহনবাবু কথাটা শেষ করতে পারলেন না।
তারপর? বলল ফেলুদা।
তরফদার বলে চললেন, আমাদের দরজায় কেল্যাপসিবল গেট লাগানো। রাত্তিরে সে গেট তালা দিয়ে বন্ধ থাকে। সেই গেট দেখি অর্ধেক খোলা, আর তালা ভাঙা। সেই আধাখোলা গেটের বাইরে মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে আমার দারোয়ান ভগীরথ। ভগীরথের পাশ দিয়ে আরও রক্তাক্ত পায়ের ছাপ চলে গেছে পাঁচিলের দিকে।
জলের ঝাপটা দিয়ে তো কোনওরকমে ভগীরথের জ্ঞান ফিরিয়ে আনলাম। সে চোখ খুলেই দানো!! দানো! বলে আর্তনাদ করে আবার ভিরমি যায়। আর কী! যাই হোক, তার কাছ থেকে যা জানা গেল তা হচ্ছে এই–মাঝরাত্তিরে সদর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সে খাইনি ডলছিল। দরজার বাইরে একটা লো পাওয়ারের বাতি সারারাত জ্বলে। এই আবছা আলোয় ভগীরথ হঠাৎ দেখে যে একটা অতিকায় প্রাণী পাঁচিলের দিক থেকে তার দিকে এগিয়ে আসছে। প্রাণীটা যে পাঁচিল টপকে এসেছে তাতে সন্দেহ নেই, কারণ গোটে রয়েছে। সশস্ত্ৰ প্রহরী।
ভগীরথ বলে সে একবার চিড়িয়াখানায় গিয়েছিল; সেখানে গরৈলা বলে একটা জানোয়ার দেখে। এই প্রাণীর চেহারা কতকটা সেইরকম, কিন্তু তার চেয়েও ঢের বেশি লম্বা আর চওড়া। এর বেশি ভগীরথ আর কিছু বলতে পারেনি, কারণ তার পরেই সে সংজ্ঞা হারায়।
বুঝেছি, বলল ফেলুদা! দানোটা তারপর কোলাপসিবল গেট ভেঙে ভেতরে ঢোকে, আর তখনই তোমার বিশ্বস্ত বাদশা দানোটার প্যায়ে কামড় দিয়ে তাকে জখম করে। এবং তার ফলেই দানব তার কাজ অসমাপ্ত রেখে পলায়ন করে।
কিন্তু যাবার আগে সে প্রতিশোধ নিয়ে যায়। বাদশার ঘাড় মটকানো মৃতদেহ পড়ে ছিল সদর দরজা থেকে ত্ৰিশ হাত দূরে-তার মুখের দুপাশে তখনও রক্ত লাগা।
আমি মনে মনে বললাম-এই ঘটনায় যদি খুশি হবার কোনও কারণ থাকে সেটা এই যে টি.এন.টি.-র উদ্দেশ্য সিদ্ধি হয়নি।
ফেলুদা চিন্তিতভাবে চুপ করে আছে দেখে তরফদার অধৈর্য হয়ে বলে উঠলেন, কিছু বলুন, মিস্টার মিত্তির?
বলার সময় পেরিয়ে গেছে সুনীল, গভীর স্বরে বলল ফেলুদা। এখন করার সময়।
কী করার কথা ভাবছেন?
ভাবছি না, স্থির করে ফেলেছি।
কী?
দক্ষিণ ভারত যাব। ম্যাড্রাস দিয়ে শুরু। নয়ন ইজ ইন গ্রেট ডেঞ্জার। তার যাতে অনিষ্ট না হয় এটা দেখার ক্ষমতা তোমাদের নেই। এখানে প্রদোষ মিত্ৰকে প্রয়োজন।
তরফদারের মুখে হাসি ফুটে উঠল। আপনি যে আমাকে কতটা নিশ্চিন্ত করলেন, তা বলতে পারব না। আপনি অবশ্য আপনার প্রোফেশনাল ক্যাপাসিটিতে কাজ করবেন, আপনার পরিশ্রমিক আর আপনাদের তিনজনের যাতায়াত ও হোটেল খরচা আমি দেব। আমি মানে—আমার পৃষ্ঠপোষক।
খরচের কথা পরে। তোমাদের যাওয়ার তারিখ তো উনিশে ডিসেম্বর, কিন্তু কোন ট্রেন সেটা জানি না।
করোমণ্ডল এক্সপ্রেস।
আমার হোটেল?
সেও হুকরোমণ্ডল।
বুঝেছি। তাজ করোমণ্ডল। তাই তো?
হ্যাঁ, আর আপনারা কিন্তু ফাস্ট ক্লাস এ.সি.-তে যাচ্ছেন। এখনই আপনাদের নাম আর বয়স একটা কাগজে লিখে দিন; বাকি কাজ সব শঙ্কর করে দেবে।
ফেলুদা বলল, বুকিং-এ অসুবিধা হলে আমাকে জানিও। রেলওয়েতে আমার প্রচুর জানাশোনা।
০৭. তরফদাররা গেলেন
তরফদাররা গেলেন পৌনে দশটায়, তারপর ঠিক পাঁচ মিনিট বাদেই ফেলুদার একটা ফোন এল, সেটা যাকে বলে একেবারে অপ্রত্যাশিত। কথা-টথা বলে সোফায় বসে শ্ৰীনাথের সদ্য আনা চায়ে একটা চুমুক দিয়ে ফেলুদা বলল, কাল ডিরেক্টরি খুলে দেখেছি, এই নামে শুধু দুটো ফোন আছে।
এই সব সামান্য ব্যাপারে আপনার সাসপেন্স তৈরি করার প্রবণতাটা আমার মোটেই ভাল লাগে না, মশাই, বললেন জটায়ু। কার ফোন সেটা হেঁয়ালি না করে বলবেন?
হিঙ্গোয়ানি।
যার কথা কাগজে বেরিয়েছে?
ইয়েস স্যার। তেওয়ারির পার্টনার।
এই ব্যক্তির কী দরকার। আপনার সঙ্গে?
সেটা ওঁর ওখানে গেলে বোঝা যাবে। ভদ্রলোক বললেন কর্নেল দালালের কাছে আমার প্রশংসা শুনেছেন।
ও, গত বছরের সেই জালিয়াতির মামলাটা।
হ্যাঁ।
অ্যাপায়েন্টমেন্ট হয়েছে?
সেটা আমার কথা থেকেই আপনার বোঝা উচিত ছিল; আপনি মনোযোগ দেননি।
আমি কিন্তু বুঝেছিলাম ফেলুদার অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়েছে আজ বিকেল পাঁচটায়। সেটা লালমোহনবাবুকে বলতে উনি বেশ রেগে গিয়ে বললেন, কানের কাছে অন্যে টেলিফোন করলে আমি অন প্রিনসিপল তার কথা শুনি না। কোথায় থাকেন। ভদ্রলোক?