আট নম্বরের দরজায় টাকা দিতে একজন রোগা, ফরাসী ভদ্রলোক দরজা খুলে আমাদের সামনে দাঁড়ালেন। বুঝলাম তিনি সবেমাত্র দাড়ি কামানো শেষ করেছেন, কারণ হাতের গামছা দিয়ে গাল মোছা এখনও শেষ হয়নি।
আপনারা–? ভদ্রলোক ফেলুদার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিলেন।
আপনি কি আপিসে বেরোচ্ছেন?
আজ্ঞে না। এখন তো ৯টা। আমি বেরোই সাড়ে ৯টায়।
ফেলুদা বলল, আমরা গত রবিবার তরফদারের ম্যাজিক দেখতে গিয়েছিলাম। সেখানে আপনার ছেলের-আপনিই তো অসীম সরকার?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আশ্চর্য অলৌকিক ক্ষমতা আপনার ছেলের। তরফদারের সঙ্গে আমাদের বেশ ভাল আলাপ হয়েছে। তাঁর কাছেই আপনার বাড়ির হদিস পেলাম। –এই দেখুন, আমরা কে তাই বলা হয়নি। । -ইনি রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস লেখক জটায়ু, এ আমার ভাই তপেশ, আর আমি প্রদোষ মিত্র।
প্রদোষ মিত্ৰ? ভদ্রলোকের চোখ কপালে। সেই বিখ্যাত গায়েন্দা প্রদোষ মিত্র-যার ডাক নাম ফেলু?
আজ্ঞে হ্যাঁ। ফেলুদা বিনয়ের অবতার।
ভেতরে আসুন, ভেতরে আসুন-কী আশ্চর্য!
আমরা ভদ্ৰলোকের পিছন পিছন ভিতরে গিয়ে একটা সরু প্যাসেজের বা দিকের দরজা দিয়ে একটা ছোট্ট ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। সেটাকে শোবার ঘর বসবার ঘর দুই-ই বলা চলে। দুটো চেয়ার আর একটা তক্তপোশ ছাড়া ঘরে কোনও আসবাব নেই। তক্তপোশের এক প্রান্তে শতরঞ্চি দিয়ে গোটানো একটা বালিশ দেখে বোঝা যায়, সেখানে কেউ শোয়। ফেলুদা আর জটায়ু চেয়ারে, অসীম বাবু আর আমি খাটে বসলাম।
ফেলুদা বলল, আপনার বেশি সময় নেব না। আমাদের আসার কারণটা বলি। সে দিন তরফদারের শো-তে আপনার ছেলের আশ্চর্য ক্ষমতা দেখে আমাদের কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শোয়ের পর তরফদারকে জিজ্ঞেস করাতে উনি বলেন ছেলেটি তাঁর কাছেই থাকে। আমি জানতে চাই যে নয়নের বাসস্থান পরিবর্তনের প্রস্তাবটা কি তরফদার করেন, না। আপনি করেন?
আপনি মহামান্য ব্যক্তি, আপনার কাছে মিথ্যা বলব না। ওঁর বাড়িতে রাখার প্রস্তাবটা তরফদার মশাই-ই করেন, তবে তার আগে নয়নকে আমিই ওঁর কাছে নিয়ে যাই।
সেটা কবে?
ওর ক্ষমতা প্ৰকাশ পাবার তিন দিন পরে। –দোসরা ডিসেম্বর।
এই সিদ্ধান্তের কারণটা কী?
এর একটাই কারণ, মিত্তির মশাই! আমার বাড়ি দেখেই বুঝতে পারছেন আমার টানাটনির সংসার। আমার চারটি সন্তান। বড়টি ছেলে, সে বি কম পড়ছে। তার খরচ আমাকে জোগাতে হয়। তারপর দুটি মেয়ে। তাদেরও স্কুলের খরচ আছে। নয়নকে এখনও ইস্কুলে দিইনি। আমি এই কালীঘাট পোস্ট আপিসেই সামান্য চাকরি করি। পুঁজি বলতে কিছুই নেই; যা আনি তা নিমেষেই খরচ হয়ে যায়; ভবিষ্যতের কথা ভেবে গা-টা বারবার শিউরে ওঠে। তাই নয়নের মধ্যে যখন হঠাৎ এই ক্ষমতা প্রকাশ পেল, তখন মনে হল—একে দিয়ে কি দু পয়সা উপার্জন করানো যায় না? কথাটা শুনতে হয়তো খারাপ লাগবে কিন্তু আমার যা অবস্থা, তাতে এমন ভাবাটা অস্বাভাবিক নয়, মিত্তির মশাই।
সেটা আমি বুঝতে পারছি, বলল ফেলুদা। এর পরেই আপনি নয়নকে তরফদারের কাছে নিয়ে যান?
আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার তো টেলিফোন নেই, তাই আর অ্যাপিয়েন্টমেন্ট করতে পারিনি, সোজা চলে যাই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে। ভদ্রলোক নয়নের ক্ষমতার দু-একটা নমুনা দেখতে চাইলেন। আমি বললুম, ওকে এমন কিছু জিজ্ঞেস করুন, যার উত্তর নম্বরে হয়। ভদ্রলোক নয়নকে বললেন, আমার বয়স কত বলতে পার? নয়ন তক্ষুনি জবাব দিল–তেত্রিশ বছর তিন মাস দশ দিন। এর পরে আর কোনও প্রশ্ন করেননি তরফদার; আমাকে বললেন–আমি যদি ওকে মঞ্চে ব্যবহার করি, তাতে আপনার কোনও আপত্তি আছে? আমি অবশ্যই পারিশ্রমিক দেব। –আমি রাজি হয়ে গেলুম। তরফদার জিজ্ঞেস করলেন-আপনি কত আশা করেন? আমি ভয়ে ভায়ে বললাম–মাসে এক হাজার। তরফদার বললেন, ভুল হল। আমার মাথায় কী নম্বর আছে, বলে তো, নয়ন? নয়ন বলল—তিন শূন্য শূন্য শূন্য। —সে ভুল বলেনি, মিত্তির মশাই। তরফদার মশাইও তাঁর কথা রেখেছেন। আগাম তিন হাজার আমি এরই মধ্যে পেয়ে গেছি। আর ভদ্রলোক যখন আমাকে বাঁচবার পথ দেখিয়ে দিলেন, তখন নয়নকে তাঁর বাড়িতে রাখার প্রস্তাবেই বা কী করে না বলি?
কিন্তু নয়ন কি স্বেচ্ছায় গেল?
সেও এক তাজ্জব ব্যাপার। এক কথায় রাজি হয়ে গেল। এখন তো ও দিব্যি আছে।
এইবারে আরেকটা প্রশ্ন করছি, বলল ফেলুদা, তা হলেই আমাদের কাজ শেষ।
বলুন।
ওর ক্ষমতার প্রথম পরিচয় আপনি কী করে পেলেন?
খুব সহজ ব্যাপার। একদিন সকালে উঠে নয়ন বলল—বাবা, আমার চোখের সামনে অনেক কিছু গিজগিজ করছে। তুমি সেরকম দেখছি না? আমি বললাম, কই, না তো। কী গিজ গিজ করছে? নয়ন বলল, এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় সাত আট নয় শূন্য। সব এ দিকে ও দিকে ঘুরছে, ছুটছে, লাফাচ্ছে, ডিগবাজি খাচ্ছে। আমার মনে হয় আমাকে যদি নম্বর নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করো তা হলে ওদের ছটফটানি থামবে। —আমার পুরোপুরি বিশ্বাস হচ্ছিল না, তাও ছেলের অনুরোধ রাখতে জিজ্ঞেস করলাম, আমার একটা খুব মোটা লাল বাঁধানো বাংলা বই আছে জানি তো? নয়ন বলল, মহাভারত? আমি বললাম, হ্যাঁ। সেই বইয়ে কত পাতা আছে বলে তো। নয়নের মুখে হাসি ফুটল। বলল, ছটফটানি থেমে গেছে। সব নম্বর পালিয়ে গেছে। খালি তিনটে নম্বর পর পর দাঁড়িয়ে আছে। কী নম্বর জিজ্ঞেস করতে নয়ন বলল, নয় তিন চার। আমি তাক থেকে কালী সিংহের মহাভারত নামিয়ে খুলে দেখি তার পৃষ্ঠা সংখ্যা সত্যি ৯৩৪।