আপনি কি আবার দাসপ্রথা চালু করলেন নাকি? জটায়ু বেশ সাহসের সঙ্গে প্রশ্ন করলেন।
নো স্যার! গৰ্জিয়ে উঠলেন টি এন টি। গাওয়াঙ্গিকে যখন দেখি তখন তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ইউগ্যান্ডার রাজধানী কম্পালা শহরে এক শিক্ষিত পরিবারের ছেলে! বাপ ডাক্তণর। তাঁর কাছেই শুনি গাওয়াঙ্গির যখন চোদ্দ বছর বয়স তখনই সে প্রায় সাত ফুট লম্বা। বাড়ির বাইরে বেরোয় না। কারণ রাস্তার লোকে ঢিল মারে। ইস্কুলে ভর্তি হয়েছিল, কিন্তু ছাত্রদের বিদ্যুপের ঠেলায় বাধ্য হয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনতে হয়। আমি যখন তাকে দেখি তখন তার বয়স একুশ। ভবিষ্যৎ অন্ধকার। চুপচাপ ঘরে বসে থাকে সারাদিন। দেখে মনে হল এইভাবে সে আর বেশিদিন বাঁচবে না। সেই অবস্থা থেকে তাকে আমি উদ্ধার করে আনি। আমার কাছে এসে সে নতুন জীবন পায়। সে আমার দাস হতে যাবে। কেন? আমি তাকে নিজের সন্তানের মতো স্নেহ করি। আমাদের সম্পর্ক পিতা-পুত্রের সম্পর্ক।
যাই হোক তারকবাবু, বললেন তরফদার, আপনার অনুরোধ রাখতে পারলাম না। আমি জ্যোতিষ্ককে চিড়িয়াখানার অধিবাসী হিসেবে কল্পনা করতে পারি না এবং চাইও না।
গাওয়াঙ্গির বিবরণ শোনার পরেও এটা বলছ?
বলছি।
ভদ্রলোক যেন একটু দমে গিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তাই যখন বলছি তখন এই ছেলেটিকে একবার দেখতে পারি কি?
সেটা সহজ ব্যাপার। আপনি সেই কলকাতার উত্তর প্রান্ত থেকে এসেছেন, আপনার জন্য এতটুকু করতে পারব না?
নয়ন এসে দাঁড়াতে তারকাবাবু তার দিকে ভুরু কুঁচকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমার বাড়িতে কটা ঘর আছে বলতে পার?
ছেষট্টি
হুঁ…
এবার তারকনাথ উঠে দাঁড়িয়ে তার লাঠির রুপো দিয়ে বাঁধানো মাথাটা ডান হাতের মুঠো দিয়ে শক্ত করে ধরে বললেন, রিমেমবার, তরফদার-টি এন টি অত সহজে হার মানে না। আমি আসি।
ভদ্রলোক চলে যাবার পর আমরা কিছুক্ষণ কোনও কথাই বললাম না। নয়নকে তার ঘরে পাঠিয়ে দিলেন তরফদার। অবশেষে লালমোহনবাবু ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, চার দিয়ে তো অনেক কিছু হয়—না মশাই? চতুর্দিক, চতুৰ্ভুজ, চতুর্মুখ, চতুৰ্বেদ-এই চারটিকে কী বলব। তাই ভাবছি।
চতুর্লোভী বলতে পারেন। বলল ফেলুদা। চার জনই যে লোভী তাতে তো কোনও সন্দেহ নেই। তবে লোভী হয়েও যে কোনও লাভ হল না সে ব্যাপারে সুনীলকে তারিফ করতে হয়।
তারিফ কোন স্যার? বললেন তরফদার। এ তো সোজা অঙ্ক। সে ছেলে আমার বাড়িতে মানুষ হচ্ছে সুস্থ পরিবেশে। আমি তাকে দেখছি। সে আমাকে দেখছে। স্রেফ লেনদেনের ব্যাপার। এ অবস্থার পরিবর্তন হবে কেন?
আমরা তিনজন উঠে পড়লাম।
একটা কথা বলি তোমাকে, তরফদারের কাঁধে হাত রেখে বলল ফেলুদা, আর অ্যাপায়েন্টমেন্ট না।
পাগল! বললেন তরফদার। এক দিনেই যা অভিজ্ঞতা হল, এর পরে আবার অ্যাপায়েন্টমেন্ট!
তবে এটা বলে রাখি। –নয়নকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে যদি আমার প্রয়োজন হয়, তা হলে আমি তৈরি আছি। ছেলেটির উপর আমার মায়া পড়ে গেছে।
থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ। প্রয়োজন হলেই খবর পাবেন।
০৬. বিষ্যুদবারের সকাল
বিষ্যুদবারের সকাল। গতকালই চতুর্লোভীর সঙ্গে সকলে কাটিয়েছি। আমরা! বেশ বুঝতে পারছি ব্যাপারটা ক্ৰমে এক্সাইটিং হয়ে আসছে, তাই বোধহয় জটায়ু তাঁর অভ্যাসমতো নটায় না এসে সাড়ে আটটায় এসেছেন।
কোন কাগজ?
স্টেটসম্যান, টেলিগ্রাফ, আনন্দবাজার…
মশাই, এক কাশ্মীরি শালওয়ালা এসে সকলটা এক্কেবারে মাটি করে দিয়ে গেল।
কাগজ-টাগজ কিছু দেখা হয়নি। কী খবর মশাই?
আমি আগেই কাগজ পড়েছি, তাই খবরটা জানতাম।
তেওয়ারি সিন্দুক খুলেছিলেন, বলল ফেলুদা, আর খুলে দেখেন সত্যিই তার মধ্যে একটি কপর্দকও নেই।
তা হলে তো নয়ন ঠিকই বলেছিল, চোখ বড় বড় করে বললেন জটায়ু। চুরিটা কখন হয়?
দুপুরে আড়াইটা থেকে সাড়ে তিনটার মধ্যে। অন্তত তেওয়ারির তাই ধারণা! সেই সময়টা তিনি আপিসে ছিলেন না। ছিলেন তাঁর ডেনটিস্টের চেম্বারে। ভদ্রলোকের স্মরণশক্তি এখন ভাল কাজ করছে। দুদিন আগেই নাকি উনি সিন্দুক খুলেছিলেন, তখন সব কিছুই ছিল। টাকার অঙ্কও মনে পড়েছে-পাঁচ লাখের কিছু উপরে। তেওয়ারি অবিশ্যি তাঁর পার্টনারকেই সন্দেহ করছেন। বলছেন একমাত্র তাঁর পার্টনারই নাকি 6 জানত; এ ছাড়া আর কাউকে কখনও বলেননি।
এই পার্টনারটি কে?
নাম হিঙ্গোয়ানি। টি এইচ সিণ্ডিকেটের টি হলেন তেওয়ারি। আর এইচ হিঙ্গোয়ানি।
যাকগে। তেওয়ারি, হিংটিংছাট, এ সবে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই। আমি খালি ভাবছি। ওই পুঁচকে ছেলে এমন ক্ষমতা পেল কী করে?
আমিও সে কথা অনেকবার ভেবেছি। ব্যাপারটা প্রথম কী করে আবিষ্কার হয়, সেটা জানার খুব আগ্রহ হচ্ছে। তোপ্সে, নয়নের বাড়ির রাস্তার নাম তোর মনে আছে?
নিকুঞ্জবিহারী লেন। কালীঘাট।
গুড।
একবার যাবেন নাকি মশাই? বলা যায় না, আমার ড্রাইভার কলকাতার এমন সব রাস্তা চেনে যার নামও আমি কস্মিনকালে শুনিনি।
সত্যিই দেখা গেল হরিপদবাবু নিকুঞ্জবিহারী লেন চেনেন। বললেন, ও রাস্তায় তো পলুন্টু দত্ত থাকতেন। আমি তখন অজিতেশ সাহার গাড়ি চালাই। একদিন তাঁকে নিয়ে গেলুম। পটু দত্তর বাড়ি। দুজনেই তো ফুটবলার, তাই খুব আলাপ।
দশ মিনিটের মধ্যে নিকুঞ্জবিহারী লেন-এ পৌঁছে একটা পানের দোকানে জিজ্ঞেস করে। জানলাম। অন্নসীম সরকার থাকেন আট নম্বরে।