আজ্ঞে না। এসেছি ছুটি কাটাতে।
না, মানে, বিরূপাক্ষ মজুমদারের বাড়িতে একজন গোয়েন্দা ঢুকছে দেখলে মনে হয়…
কেন? উনি কি কোনও গোলমালে জড়িয়ে আছেন নাকি?
ইয়ে, ওঁর সম্বন্ধে পাঁচ রকম গুজব শোনা যায় তো!
ওঃ, তাই বলুন! না, উনি কোনও গোলমালে জড়িয়ে আছেন বলে মনে হল না। আর গুজবে কান দেওয়াটা আমি বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি না।
তা তো বটেই। তা তো বটেই।
আমার মনে হল, ফেলুদা ইচ্ছে করেই মিঃ মজুমদারের লেটেস্ট ব্যাপারটা চেপে গৈল। ইনি কোথাকার কে তা কে বলতে পারে? আর ভদ্রলোক সত্যিই তো উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন।
কেভেনিটারসের ছাতে আলো অল্পই, কিন্তু তার মধ্যেই দেখছিলাম। লালমোহনবাবু পকেট থেকে তাঁর কাগজটা বার করে ডায়লগট আউড়ে দেখছেন।
তা হলে উঠি? আলাপ করে খুব ভাল লাগল।
হরিনারায়ণ মুখার্জি চলে গেলেন।
মনে হল ভদ্রলোক এখানকার অনেক দিনের বাসিন্দা, ফেলুদা মন্তব্য করল।
সেটা আবার কী করে বুঝলেন মশাই?
আমাদের চেয়ে শীতটা বেশি সহ্য করতে পারেন। সুতির শার্টের উপর একটা গরম চাদর জড়িয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। পায়ে মোজাও পারেননি। ভদ্রলোককে একটু কালটিভেট করতে পারলে মন্দি হত না?
কেন?
আজ জানান দিয়ে গেলেন যে ওঁর কাছে খবর আছে।
কেন জানি না, হট চকোলেটটা খেতে খেতে মনে হচ্ছিল যে ঘটনা যেভাবে এগোচ্ছে, যে-সব লোকের সঙ্গে আলাপ করে যে-সব খবর জানতে পারছি, তার থেকে একটা বিস্ফোরণ ঘটা খুব আশ্চর্য নয়; কিন্তু সেটা যে এত তাড়াতাড়ি ঘটবে সেটা ভাবতেই পারিনি।
০৫. পরদিন ব্রেকফাস্ট শেষ করতে না করতে
পরদিন ব্রেকফাস্ট শেষ করতে না করতে পুলক ঘোষালের কাছ থেকে গাড়ি নিয়ে লোক এসে গেল লালমোহনবাবুর জন্য। আগের দিন রাত্রে ফেলুদার কাছ থেকে তালিম নিয়ে লালমোহনববাবু তাঁর সাড়ে তিন লাইন ডায়লগটা তৈরি করে নিয়েছিলেন। যে লোকটি তাঁকে নিতে এল সে বাঙালি, নাম নীতিশ সোম। সে বলল আজ প্রথম দিন, তাই শুটিং আরম্ভ হতে হতে বারোটা হবে। কিন্তু লালমোহনবাবুর মেক-আপ আছে। তাই তাঁকে আগে প্রয়োজন। জামাকাপড়ের কথা পুলকবাবু আগেই বলে দিয়েছিলেন ফোন করে; লালমোহনবাবু নিজের কোট-প্যান্টই পরবেন, তবে কী রঙের সেটা এখনও ঠিক হয়নি, তাই তিনি সঙ্গে যা এনেছেন সবই নিয়ে যেতে হবে। আমিও যেতে চাই শুনে নীতিশবাবু বললেন, আপনি বরং এগারোটা নাগাত আসবেন। ততক্ষণে আমাদের তোড়জোড় প্রায় শেষ হয়ে যাবে। তা ছাড়া আজ তো মহরত, তাই একটা ছোট অনুষ্ঠান আছে। সেটা এগারোটায় এলে দেখতে পাবেন। আপনি দুপুরের লাঞ্চটীও না হয় আমাদের সঙ্গেই করবেন; হোটেল থেকে প্যাক্ড লাঞ্চ আসবে।
সাড়ে আটটার মধ্যেই একটা সুটকেস নিয়ে দুগ্ৰগ বলে। লালমোহনবাবু বেরিয়ে পড়লেন।
আমি আর ফেলুদা নটা নাগাত হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আজ আমরা একটু জালাপাহাড় রোড দিয়ে হাঁটব। ফেলুদা বলল, দাৰ্জিলিং-এ এসে সকালটা হোটেলে বসে থাকার কোনও মানে হয় না।
আজকের দিনটাও রোদ-ঝলমল, উত্তরে কাঞ্চনজঙ্ঘা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। ম্যালের বেঞ্চিতে লোক ভর্তি, কারণ পুজোয় অনেক চেঞ্জীর এসেছে। আমরা ঘোড়ার স্ট্যান্ড ছাড়িয়ে জালাপাহাড় রোড দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। ফেলুদা সিগারেট খাওয়া অনেক কমিয়ে দিলেও ব্রেকফাস্টের পর একটা না খেয়ে পারে না। একটা চারমিনার ধরিয়ে দৃশ্য দেখতে দেখতেই আমাকে প্রশ্ন করল, হালচাল কীরকম বুঝছিস?
আমি বললাম, এখন পর্যন্ত বিরূপাক্ষ মজুমদারকেই সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং লোক বলে মনে হচ্ছে।
সেটা ঠিক। অবিশ্যি তার একটা কারণ হচ্ছে যে, একমাত্র এই ভদ্রলোক সম্বন্ধেই আমরা বেশ কিছু তথ্য জেনেছি, আর সেগুলো খুবই ইন্টারেস্টিং; যে লোক দিনে ঘুমোয় আর রাতে জাগে, যে লোক গরম গরম খবর কাগজ থেকে কেটে খাতায় সেঁটে রাখে, যে বলে যে তার জীবনে একটা রহস্য আছে কিন্তু সেটা সে প্রকাশ করতে চায় না, আর যে একটা মহামূল্য জিনিস সিন্দুকে না রেখে তার ঘরের তাকে রাখে, তাকে কোনও মতেই স্বাভাবিক মানুষের পষাঁয়ে ফেলা চলে না।
ওঁর ছেলে তো প্রায় কথাই বললেন না।
হ্যাঁ। আমার কাছে ভদ্রলোককে বেশি রহস্যজনক বলে মনে হল; ভাবটা যেন বেশি। কথা বললে কোনও রহস্য প্রকাশ পেয়ে যাবে, তাই সামলে চলছে।
আর রজতবাবু?
তোর কী মনে হল?
মনে হল যে লোকটার চোখ খারাপ কিন্তু চশমা নেয়নি। একটা মোড়ায় ধাক্কা খেলেন। দেখলে না?
একসেলেন্ট! একদম ঠিক বলেছিস; চশমাটা হয়তো ভেঙেছে; আর মাইনাস পাওয়ার তাতে সন্দেহ নেই।–অর্থাৎ দূরের জিনিস দেখতে পায় না, কাছের জিনিস পায়–ত না হলে ঠিক ঠিক খাতাগুলো আনতে পারত না।
আর বম্বের হিরো আর ভিলেন?
তোর কী মনে হয়? আজকে তোর পরীক্ষাই হোক।
কাল একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ করলাম।
কী?
লালমোহনবাবু যখন নদু মল্লিকের পাখোয়াজের বালটা বলছিলেন, তখন রায়না। আর ভার্মা দুজনের ঠোঁটের কোণেই হাসি দেখা দিল।
এটাও দুর্দান্ত বলেছিস।
তার মানে কি ওরা বাংলা জানে?
আসলে বম্বের ফিল্ম-জগতে এত বাঙালি কাজ করে যে, বাংলাটা অল্পবিস্তর অনেকেই বুঝতে পারে, বলতে না পারলেও।
ওদের দুজনকে দেখে মিঃ মজুমদার একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন, সেটা লক্ষ করেছিলো নিশ্চয়ই।
তা তো বটেই।
অবিশ্যি মিঃ মজুমদারের মনটা যেন মাঝে মাঝেই অন্য দিকে চলে যায়, তাই না?