অবজারভেটটি হিলের পুবের রাস্তাটা দিয়ে গিয়ে যেই বাঁয়ে মোড় নিয়েছি, অমনি সামনে দেখি বিকেলের পড়ন্ত রোদে কাঞ্চনজঙ্ঘায়ু সোনার রং ধরতে শুরু করেছে। লালমোহনবাবুর আবার কাব্যের মেজাজ এসে পড়ল, অয়ি কাঞ্চনজঙেঘ বলে আর বাকি কবিতাটা বললেন না। আমরা পুরো পাহাড়টা চক্কর দিয়ে আবার যখন ম্যালে ফিরে এলাম তখন পাঁচটা বেজে গেছে, সূর্য পাহাড়ের পিছনে চলে গেছে। পুবে জালাপাহাড় রোডের দিকে চেয়ে দেখি ঘোড়ার স্ট্যান্ডের সামনে দিয়ে শুটিং-এর দল মালপত্তর কাঁধে নিয়ে ফিরছে, তার পিছনে লোকের ভিড়। তবে এ ভিড় মোটামুটি ভদ্র, বেশি উৎপাত করবে বলে মনে হল না। রায়না। আর ভার্মা দুজনকেই কিছু অটাগ্রাফে সই দিতে হল সেটা দেখলাম। তার পর দলটা বাঁয়ে নেহরু রোড ধরে বোধহয় সোজা হোটেলের দিকে চলে গেল।
গুড ইভনিং!
ঘোড়ার পিঠে বিরূপাক্ষ মজুমদার। আমাদের দেখে নেমে এলেন।
একটা কথা আজ সকলে আপনাকে বলা হয়নি, মিঃ মজুমদার ফেলুদাকে উদ্দেশ করে গলা নামিয়ে কথাটা বললেন। তারপর আরও কাছে এগিয়ে এসে বললেন, এ খবরটা আমার মালীর কাছ থেকে শোনা; কত দূর রিলায়েবল তা বলতে পারব না।
কী খবর? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
ক দিন থেকেই নাকি একটি লোককে আমাদের গেটের বাইরে বাড়ির আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে।
বলেন কী।
মালীও তাই বলে। লোকটা পুরনো, তার কথা অবিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই।
লোকটার কোনও বর্ণনা দিয়েছে?
বলছে মাঝারি হাইট, রং মাঝারি, খোঁচা খোঁচা দাড়ি আছে। মুখ ভাল করে দেখেনি, কারণ চোখে চোখ পড়তেই লোকটা গাছের আড়ালে চলে যায়। তবে সিগারেট বা বিড়ি খায় এটা মালী বলল, কারণ গাছের পিছন থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখেছে।
এইভাবে দৃষ্টি রাখার কোনও কারণ খুঁজে বার করতে পারেন আপনি?
তা পারি। আমার বাড়িতে একটা মূল্যবান জিনিস আছে। অষ্টধাতুর তৈরি একটা বালগোপাল। আমাদের পৈতৃক বাড়ির মন্দিরের মধ্যে ছিল এটা। নয়নপুরে। জিনিসটা খুবই ভ্যালুয়েবল? আর সেটা এখানে অনেকেই দেখেছে।
সেটা কোথায় থাকে?
আমার শোবার ঘরে তাকের উপর।
খোলা অবস্থায়?
আমি তো রাত্রে জেগে থাকি, আর আমার সঙ্গে রিভলভার থাকে, কাজেই চোর বিশেষ কিছু করতে পারবে না।
আর কোনও কারণে লোক হানা দিতে পারে?
আমি এটুকু বলতে পারি যে আমার অনিষ্ট করতে চাইবে এমন লোক থাকা অসম্ভব নয়। এটা কেন বলছি তার কারণ জিজ্ঞেস করবেন না। আমি শুধু এইটুকু জানতে চাই যে এর মধ্যে যদি কিছু ঘটে তা হলে আপনার সাহায্য আশা করতে পারি তো?
দ্যাট গোজ উইদাউট সেইং, বলল ফেলুদা।
তা হলেই নিশ্চিন্ত, বললেন ভদ্রলোক।
এমন সময় একটি বছর ত্ৰিশের ভদ্রলোক আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন।এসো সমীরণ, তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই বললেন মিঃ মজুমদার।ইনি হচ্ছেন আমার একমাত্র পুত্র সমীরণ, আর ইনি প্রদোষ মিত্র, আর ইনি লালচাঁদ–স্যারি, লালমোহন…গাঙ্গুলী তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আর ইনি প্রদোষবাবুর কাজিন।
সমীরণ মজুমদার বেশ স্মর্ট দেখতে, তার উপর একটা গাঢ় লাল জার্কিন পরাতে আরও স্মার্ট দেখাচ্ছে। বললেন, আপনি তো বিখ্যাত ডিটেকটিভ?
বিখ্যাত কিনা জানি না, বলল ফেলুদা, তবে ডিটেকশন আমার পেশা বটে।
আমি আবার খুব গোয়েন্দা কাহিনীর ভক্ত। আপনার সঙ্গে এক’দিন বসে কথা বলার ইচ্ছা! বইল।
আজ একটু শপিং-এ বেরিয়েছি। এক্সকিউজ মি।
সমীরণবাবু চলে গেলেন।
আমিও আসি। ঘোড়ার পিঠে চড়ে বললেন মিঃ মজুমদার।আবার দেখা হবে নিশ্চয়ই।
প্রয়োজনে টেলিফোন করতে দ্বিধা করবেন না, বলল ফেলুদা। আমরা উঠেছি কাঞ্চনজঙ্ঘা হোটেলে।
ইতিমধ্যে একটি অচেনা ছেলে এসে লালমোহনবাবুর হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে গেছে। সেটা নাকি ওঁর আগামীকালের ডায়ালগ। হিন্দি ডায়ালগ বাংলা অক্ষরে লিখে দিয়েছে, সুবিধাই হল।
অনেক কথা আছে? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
সাড়ে তিন লাইন, শুকনো গলায় বললেন লালমোহনবাবু।
হোটেলে ফিরে গিয়ে একবার দেবেন তো আমাকে ডায়ালগটা, বলল ফেলুদা। আপনাকে একটু তালিম দিয়ে দেব। আপনার হিন্দিতে বড় বেশি শ্যামবাজারের টান এসে পড়ে।
আমরা গতকালের মতো আজকেও ফেরার আগে একবার কেড়েনটারসের ছাতে গিয়ে বসলাম হট চকোলেট খাবার জন্য। ঠাণ্ডা বেশ কনকনে, তার উপর মেঘ নেই বলে শীত আরও বেশি। এর মধ্যেই অনেক তারা বেরিয়ে পড়েছে আকাশে, আর তার সঙ্গে আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে ছায়াপথটা।
এখানে বসতে পারি?
আমরা তিনজন একটা টেবিলে বসেছিলাম। আমাদের পাশে একটা চেয়ার খালি ছিল; এবার দেখলাম। একজন বছর ষাটেকের বাঙালি ভদ্রলোক সেটার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে হাসি-হাসি মুখ করে চেয়ে আছেন। চোখে চশমা, কাঁচা-পাকা মেশানো গোঁফ আর মাথার চুল।
বসুন, বলল ফেলুদা।
আপনার পরিচয় আমার জানা আছে, ভদ্রলোক ফেলুদার দিকে চেয়ে বললেন, আপনার একটা ছবি সমেত সাক্ষাৎকার বোধহয় একটা বাংলা পত্রিকায় বেরিয়েছিল। বছর খানেক আগে।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
কিন্তু এঁকে তো–?
ইনি ঔপন্যাসিক লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়।
কিছু মনে করবেন না-এভাবে উড়ে এসে জুড়ে বসলাম-কিন্তু আজ। আপনাদের দেখলাম আমার পাশের বাড়িতে ঢুকতে। আমি নয়নপুর ভিলার উত্তরের বাড়িটায় থাকি।
বাড়িটার নাম দ্য রিট্রিট, আর আমার নাম হরিনারায়ণ মুখার্জি।
নমস্কার।
নমস্কার—ইয়ে, আপনি কি কোনও তদন্তের ব্যাপারে এখানে এসেছেন?