বিলক্ষণ!
আপনি তাতে নদু মল্লিকের পার্ট করেছিলেন, মনে আছে?
বাবা, সে কি ভুলতে পারি! পাখোয়াজের বোলটা পর্যন্ত এখনও মনে আছে–ধা ধা ধিন্তা কত্তা গে, গিন্নী ঘা দেন কর্তাকে!–ওঃ! সে কি ভোলা যায়? জীবনে আমার প্রথম এবং শেষ অভিনয়।
না না, শেষ নয়।
মানে?
এখানকার বেঙ্গলি ক্লাব আমাদের ডুবিয়েছে। বলেছিল দু-একটা ছাট পার্টের জন্য লোক দেবে, এখন বলছে তারা কলকাতায় চলে গেছে ছুটিতে। বিশেষ করে একটি পার্ট—বুঝেছেন। লালুদা, ভিলেনের রাইট হ্যান্ড ম্যান—
কে—অঘোরাচাঁদ বাটালিওয়ালা?
হ্যাঁ দাদা!
কিন্তু তার তো বেশি কিছু করার নেই; শুধু দুটো সিন।
সেই দুটো সিন আমাদের একটু উদ্ধার করে দিতে হবে দাদা! কথা খুব কম। আজ বিকেলে গিয়ে আপনাকে ডায়ালগ দিয়ে আসবে। এ কাজটা কাইন্ডলি আপনি করে দিন। সবসুদ্ধ তিন দিনের কাজ।
আমরা কিন্তু আর দশ দিন মাত্ৰ আছি।
এক উইকের মধ্যে আপনার কাজ শেষ করে দেব।
কিন্তু এই চেহারা নিয়ে—
আপনাকে মেক-আপ দেব। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আর একটা পরচুলা। ফাস্টক্লাস মানাবে। কেয়া ভাই মহাদেব, মেরা চয়েস মে কুছ গলতি হ্যায়?
নেহি নেহি ভাই, বললেন মহাদেব ভার্মা।
আপনার সিগার খাওয়ার অভ্যোস আছে? লালমোহনবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন পুলক ঘোষাল।
ধূমপান করতুম এককালে, হাত কচলাতে কচলাতে বললেন লালমোহনবাবু, কিন্তু সিগারেট ছেড়েছি দশ বছর হল।
তাতে কী হল? আর হ্যাঁ, চোখে একটা কালো চশমা।
বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, লালমোহনবাবু ব্যাপারটাতে ক্ৰমেই মেতে উঠছিলেন। এবার বললেন, ওককে! যখন এত করে বলছি, তখন না করব না। আমার নিজের গল্পে একটা গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স থাকলে মন্দ কী? কিন্তু একটা কথা।
কী?
আমার নামের পাশে যেন একটা অ্যাঃ থাকে। পেশাদারি অভিনেতা হতে আমি নারাজ। হলে অ্যামেচার, আর না হলে নয়। ঠিক তো?
ওককে! বললেন পুলক ঘোষাল।
এই সুযোগে আমিও একটা ব্যাপার সেরে নিলাম। পুলক ঘোষালকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি শুটিং দেখতে আসতে পারি তো?
একশোবার, ভাই, একশোবার, বললেন পুলক ঘোষাল।
০৪. পুলক ঘোষালের দল
পুলক ঘোষালের দল তাদের কথা সেরে শুটিং-এর তোড়জোড় করতে চলে গেল। আমাদের কফি খাওয়া শেষ, তাই আমরাও আর বসলাম না। ফেলুদাই প্ৰথমে উঠে পড়ে বলল, আজি তা হলে আসি?
অ্যাঁ?
ভদ্রলোক যেভাবে প্রশ্নটা করলেন তাতে বুঝতেই পারলাম, তিনি কোনও একটা কারণে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন। পরমুহূর্তেই অবিশ্যি নিজেকে সামলে নিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই বললেন, উঠবেন? ঠিক আছে। রয়েছেন যখন ক’দিন, তখন দেখা হবে নিশ্চয়ই।
আমরা তিনজনে নয়নপুর ভিলা থেকে বেরিয়ে উতরাই দিয়ে হোটেলমুখে রওনা দিলাম!
ফেলুদা পথে কিছুই বলল না। কেন জানি, ও-ও একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। দুপুরে লাঞ্চ খাবার সময় লালমোহনবাবুর দিকে ফিরে বলল, কী মশাই, আমাদের অ্যাদ্দিনের আলাপ, আর এমন একটা খবর আপনি বেমালুম চেপে গেসলেন? ভূশণ্ডীর মাঠেতে নদু মল্লিক? বাংলা সাহিত্যে এমন একটি চরিত্র খুঁজে পাওয়া ভার, আর আপনি সেই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন?
লালমোহনবাবু একটা ফিশ ফ্রাইয়ের টুকরো মুখে পুরে দিয়ে বললেন, আরে মশাই, সে-রকম বলতে গেলে তো অনেক কিছুই বলতে হয়। নর্থ ক্যালকাটায় ক্যারাম চ্যাম্পিয়ন ছিলুম। ফিফটি নাইনে—এ খবর জানতেন? এনডিওরেন্স সাইক্লিং-এ আমার কত কীর্তি আছে, সে সব আপনি জানেন? আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় মেডেল পেয়েছি—একবার নয়, থ্রি টাইমস্! দেবতার গ্রাস পুরো মুখস্থ ছিল। ফিল্মে অফার বিশ বছর আগেও পেয়েছি—তখন আমার মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল-ভাবতে পারেন? কিন্তু সে অফার নিইনি। তখন থেকেই মাইন্ড মেক আপ করেছি যে লেখক হব। শখের লেখক নয়, পেশাদারি লেখক। স্রেফ লিখে পয়সা করা যায়। কিনা দেখব। তার পরের ইতিহাস অবিশ্যি খুব সহজ। খগেন জ্যোতিষী বলেছিল–তোমার কলমে জাদু আছে, তুমি লেখো। তবে এতটা যে সাকসেস হবে, তা অবিশ্যি ভাবতে পারিনি।
একটা কথা কিন্তু বলে রাখছি, বলল ফেলুদা।
কী?
এরা আপনাকে দিয়ে চুরুট খাওয়াবে। আপনি দশ বছর হল স্মেকিং ছেড়েছেন। সুতরাং একটা বিপর্যায়র সম্ভাবনা আছে।
বলছেন?
বলছি। এক কাজ করবেন। আজই একটা চুরুট কিনে ধোঁয়াটা পেটে না নিয়ে খাওয়া অভ্যাস করুন। পেটে গেলেই কিন্তু কাশির দমকের চোটে শট একেবারে মাটিংচকার হয়ে যাবে।
থ্যাঙ্ক ইউ ফর দি অ্যাডভাইস, স্যার।
দুপুরে একটু বিশ্রাম করে চারটে নাগাত আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আজ অবজারভেটরি হিলটায় একটা চক্কর মারার ইচ্ছে আছে। পাহাড়ের উত্তর দিক থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার একটা চমৎকার ভিউ পাওয়া যায়।
লালমোহনবাবু প্রথম যে সিগারেটের দোকানটা পেলেন, সেখান থেকেই একটা চুরুট কিনে নিলেন। প্রথম টানে ধোঁয়া পেটে চলে গিয়ে সত্যিই একটা বিপর্যয় হতে যাচ্ছিল, কিন্তু ভদ্রলোক সেটা কোনও মতে সামলে নিয়ে তারপর থেকে খুব সাবধানে ধোঁয়া টানামাত্র সেটা ছেড়ে দিতে লাগলেন। চুরুট হাতে নেবার সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোকের পাসেৰ্ণনালটির একটা বদল লক্ষ করছিলাম। বেশ একটা মিলিটারি মেজাজ, জুতোর গোড়ালি দিয়ে শব্দ তুলে হাঁটা, ঠোঁটের কোণে একটা মৃদু হাসি নিয়ে এদিক-ওদিক চাওয়া। বুঝলাম, ভদ্রলোক অঘোরাচাঁদ বাটলিওয়ালার চরিত্রে অভিনয় করতে করতে চলেছেন।