হ্যাঁ, বললেন বিরূপাক্ষ মজুমদার। লন্ডনে আমার এক ডাক্তার বন্ধু আছে। তাকে বলাই আছে-কোনও সেনসেশনাল খবর পেলেই যেন আমাকে কেটে পাঠিয়ে দেয়।
খুন রাহাজানি অ্যাক্সিডোন্ট অগ্নিকাণ্ড আত্মহত্যা–কিছুই বাদ নেই দেখছি।
তা নেই, বললেন মিঃ মজুমদার।
কিন্তু আপনি কী একটা ক্রাইমের কথা বলেছিলেন, যেটার কোনও কিনারা হয়নি?
হ্যাঁ–তেমন একটা ক্রাইম আছে বটে। সেটার খবর আপনি খাতায় পাবেন; আরেকটি আছে যেটা খাতায় পাওয়া যাবে না, কারণ সেটা খবরের কাগজের কানে পৌঁছায়নি।
সেটা কী ব্যাপার?
সেটা আমায় জিজ্ঞেস করবেন না, কারণ তার উত্তর আমি দিতে পারব না। আমায় মাপ করবেন। যাই হাক, রজত—একবার যাও তো সিক্সটি নাইনের ভালুমটা নিয়ে এসো।
রুজতবাবু এবার আর একটা খাতা নিয়ে এসে ফেলুদাকে দিলেন।
খাতার মাঝামাঝি পাবেন খবরটা, বললেন মিঃ মজুমদার।জুন মাসে ঘটে ঘটনাটা। স্টেটসম্যানের খবর, হেডিং হচ্ছে, যত দূর মনে পড়ে—এমবেজুলার আনট্রেসড।
পেয়েছি বলল ফেলুদা। তার পর কিছুটা পড়েই বলল, এ যে দেখছি আপনাদেরই ব্যাঙ্কের ঘটনা!
সেই জন্যেই তো। ওটা ভুলতে পারি না, বললেনঃ মিঃ মজুমদার।পড়লেই বুঝতে পারবেন, আমাদেরই ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের একটি ছেলে, নাম ভি. বাল্যাপোরিয়া, প্রায় দেড় লাখ টাকা ব্যাঙ্ক থেকে হাতিয়ে উধাও হয়ে যায়। পুলিশ বিস্তর চেষ্টা করেও তার আর সন্ধান পায়নি। আমি তখন ছিলাম ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার।
ফেলুদা বলল, যদিও অনেক’দিনের ঘটনা, তাও আমার ব্যাপারটা আবছা আবছা মনে আছে। গোয়েন্দা হবার আগে এই ধরনের ক্রাইমের খবর আমিও খুঁটিয়ে পড়তাম!
ইতিমধ্যে লালমোহনবাবু আর আমিও খবরটা পড়ে ফেলেছি।
বিরূপাক্ষবাবু বললেন, তখনই আমার একবার মনে হয়েছিল যে, শার্লক হামস বা এরক্যুল পোয়ারোর মতো একজন প্রাইভেট গোয়েন্দা থাকলে হয়তো ব্যাপারটার একটা সুরাহা হত। পুলিশের উপর আমার নিজের যে খুব একটা আস্থা আছে, তা নয়।
ফেলুদা কিছুক্ষণ খাতাটা উলটে পালটে দেখে। ধন্যবাদ দিয়ে ফেরত দিয়ে দিল।
ইতিমধ্যে কফি এসে গেছে। বেয়ারাটির বেশ ভদ্র চেহারা, হঠাৎ দেখলে চাকর বলে মনে হয় না। আমরা ট্রে থেকে কফি তুলে নিলাম।
ফেলুদা বলল, বাইরে আপনার ঘোড়াটা দেখলাম; আপনি বুঝি ওটাতেই চলা-ফেরা করেন?
মিঃ মজুমদার বললেন, চলা-ফেরা মানে আমি শুধু বিকেলে একবার বেরোই। বাকি সময়টা আমি বাড়িতেই থাকি। আমার অভ্যাসগুলো ঠিক সাধারণ মানুষের মতো নয়। রিটায়ার করার পর থেকে আমার রুটিনটা একটা অদ্ভুত চেহারা নিয়েছে। আমার ইনসমনিয়া আছে, সে কথা আগেই বলেছি। আমি ঘুমেই দুপুরবেলা, তাও এক গেলাস দুধের সঙ্গে একটা করে বড়ি খেয়ে; ঘড়িতে অ্যালাম দিয়ে শুই উঠি ঠিক পাঁচটায়। তারপর চা খেয়ে বেরেই। রাত্তিরটা আমি বই পড়ি।
একদমই ঘুমোন না রাত্রে? ফেলুদা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
একদমই না, বুললেন ভদ্রলোক।অবিশ্যি, এককালে আমার ঠাকুরদাদারও শুনেছি। এই বাতিল ছিল। তিনি ছিলেন ডাকসাইটে জমিদার। তাঁর রাতটা ছিল দিন, আর এদিনটা রাত। জমিদারির কাজকর্ম তিনি রাত্রেই দেখতেন, আর সারা দুপুর আফিং খেয়ে ঘুমোতেন। ভাল কথা, আপনার ধূমপানের প্রয়োজন হলে আমার সামনেই করতে পারেন; আই ডোন্ট মাইন্ড।
থ্যাঙ্ক ইউ, বলে ফেলুদা একটা চারমিনার ধরাল। বিরূপাক্ষবাবুর ষাটের কাছে বয়স হলেও তাঁকে বৃদ্ধ বলে মোটেই মনে হয় না।
কাল থেকে তো আপনার বাড়িতে শুটিং শুরু হবে, বলল ফেলুদা? আপনার উপর দিয়ে অনেক ধকল যাবে।
আই ডোন্ট মাইন্ড), বললেন ভদ্রলোক। আমি থাকব বাড়ির উত্তর প্রান্তে, কাজ হবে। দক্ষিণ দিকটায়। পরিচালক ভদ্রলোকটিকে বেশ ভাল লাগল, তাই আর না করলাম না।
এই কথা বলতে বুলতেই একটা জিপের আওয়াজ পেয়ে ঘুরে দেখি ফিল্মের দল এসে গেছে। বাগান পেরিয়ে দরজার মুখে এসে টাকা মারলেন পুলক ঘোষাল।
কাম ইন স্যার, বলে উঠলেন বিরূপক্ষ মজুমদার।
পুলক ঘোষাল ঢুকে এলেন, তাঁর পিছনে মহাদেব ভার্মা আর রাজেন রায়না।
আমরা শুটিং-এ বেরোচ্ছি, বলল পুলক ঘোষাল, তাই ভাবলাম একবার আপনার সঙ্গে দেখা করে যাই। কাল থেকে তো আপনার এখানেই কাজ, তা ছাড়া এই দুটি অভিনেতার সঙ্গে আপনার আলাপও হয়নি। ইনি হলেন ছবির নায়ক রাজেন রায়না, আর ইনি হলেন ভিলেন মহাদেব ভার্মা।
বসুন, বসুন, বললেন মিঃ মজুমদার। যখন এলেন, তখন একটু কফি খেয়ে যান।
না স্যার; আজ আর বসব না। কাল থেকে তো প্ৰায় সারাটা দিনই এখানে থাকতে হবে। ভাল কথা, আপনার সেক্রেটারি বলছিলেন। আপনি নাকি দুপুরটা ঘুমোন। তা, দুপুরে তো আমাদের কাজ হবে, এ বাড়ি থেকে একটু দূরে আমাদের জেনারেটর চলবে। তাতে আপনার ব্যাঘাত হবে না তো?
মোটেই না, বললেন মিঃ মজুমদার। আমি দরজা-জানলা ভেজিয়ে পরদা টেনে শুই। বাইরের কোনও আওয়াজ ঘরে ঢোকেই না।
লক্ষ করছিলাম ভদ্রলোক কথা বলার সময় রায়না। আর ভার্মার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখছেন। বললেন, যাক, এবার তা হলে বলতে পারব যে, ফিল্মস্টারের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। অ্যাদ্দিন এ সৌভাগ্যটা হয়নি।
এবার পুলক ঘোষাল লালমোহনবাবুর দিকে ফিরলেন।
লালুদা, আপনাকে একটা রিকোয়েস্ট ছিল।
কী ভাই?
আমার মেমরি খুব শাপ, লালুদা। আমার স্পষ্ট মনে আছে, নাইনটিন সেভেনটিতে গড়পারে ফ্রেন্ডস ক্লাবে ভূশঔীর মাঠে প্লে হয়েছিল। সরস্বতী পুজোয়। আপনার মনে পড়ছে?