অয়ি কাঞ্চনজঙ্ঘে!
দেখেছি তোমার রূপ উত্তরবঙ্গে
মুগ্ধ নেত্ৰে দেখি মোরা তোমারে প্রভাতে
সাঁঝেতে আরেক রূপ, ভুল নেই তাতে–
তুষার ভাস্কর্য তুমি, মোদের গৌরব
সবে মিলে তোমারেই করি মোরা স্তব।
আবৃত্তি শেষ করে দম নিয়ে বললেন, সম্বোধনে আ-কারটা এ-কার হয়ে যায়-সেটাকে কীভাবে কাজে লাগিয়েছেন কবি, দেখছি তপেশ?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, দেখেছি, যদিও সংস্কৃত ব্যাকরণটা ভাল জানা নেই বলে ভদ্রলোক ঠিক বলছেন না ভুল বলছেন, সেটা বুঝতে পারলাম না।
এটাই গ্রেট পোয়েটের লক্ষণ, বললেন লালমোহনবাবু।
ফেলুদাও অবিশ্যি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছিল, তবে সেটা হোটেলের বাইরে থেকে। ও ভোরে উঠে যোগব্যায়াম সেরে আমি ওঠার আগেই বেরিয়ে পড়েছিল। তার পর ম্যাল থেকে অবজারভেটারি হিলের চারিদিকে চক্কর মেরে চায়ের ঠিক আগে ফিরে এসেছিল। বলল, যতবার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখি, ততবার বয়সটা যেন কিছুটা কমে যায়। আর সবচেয়ে ভাল কথা—যেখানে—সেখানে বাড়ি উঠে শহরটার অনেক ক্ষতি করলেও অবজারভেটরি হিলের রাস্তাটার কোনও পরিবর্তন হয়নি।
আমারও আজ প্রথম মনে হল যেন জন্ম সার্থক, বললেন লালমোহনবাবু।
যাক! বলল ফেলুদা।এত গাঁজাখুরি গল্প লিখেও যে আপনার সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো টিকে আছে, সেটা জেনে খুব ভাল লাগল।
আজি তা হলে আমরা কী করছি?
আমরা হোটেলের ডাইনিং রুমে ব্রেকফাস্ট করছিলাম; ফেলুদা কাঁটা দিয়ে ওমলেটের খানিকটা অংশ মুখে পুরে বলল, আজ সকালে একবার মজুমদার মশাইয়ের ওখানে যাবার ইচ্ছে আছে। কাল থেকে ওঁর বাড়িতে শুটিং আরম্ভ হয়ে যাবে, তখন বড্ড ভিড়। আজ মনে হয় নিরিবিলি বসে একটু কথা বলা যাবে। এমন লোককে কালটিভেট করাটা আমি কর্তব্যের মধ্যে ধরি।
তথাস্তু, বললেন লালমোহনবাবু।
আমরা সাড়ে আটটায় বেরিয়ে পড়লাম। ম্যাল থেকে নেমে দাশ স্টুডিয়ো আর কেভেনটারের পাশ দিয়ে নেহরু রোড ধরে সোজা তিন কোয়াটার মাইল গেলে মাউন্ট এভারেস্ট হোটেল। সেটা ছাড়িয়ে গেলেই পাব আমরা মিঃ মজুমদারের বাড়ির রাস্তা।
সেই রাস্তা ধরে কিছু দূর উঠতেই একজন বাঙালি ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করতে উনি বলে দিলেন যে, আর মিনিট খানেক হাঁটলেই আমরা নয়নপুর ভিলাতে পৌঁছে যাব।
বাড়ি খুঁজে পেতে কোনওই অসুবিধা হল না। লাল টালির ছাদওয়ালা কাঠের বাংলো বাড়ি, বেশ ছড়ানো, তিন দিক ঘিরে রয়েছে সুন্দর বাগান, আর পিছনে পুব দিকে ঝাউবনের পরেই উঠেছে খাড়াই পাহাড়।
বাগানে একটা মালী কাজ করছিল, সে আমাদের দেখেই এগিয়ে এল।
মিঃ মজুমদার আছেন? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
কী নাম বলব?
বলো যে, কাল যাঁর সঙ্গে সন্ধ্যায় আলাপ হয়েছিল, সেই মিত্তিরবাবু দেখা করতে এসেছেন।
মালী খবর দিতে চলে গেল। আমি অবাক হয়ে বাড়িটার শোভা দেখছিলাম। উত্তরে চাইলেই সোজা কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে। এখন ঝলমলে রুপোলি। যিনিই বাড়িটা বানিয়ে থাকুন, তাঁর রুচির তারিফ করতে হয়।
মালীর পিছন পিছন দেখি, মিঃ মজুমদার নিজে বেরিয়ে এসেছেন।
গুড মর্নিং! আসুন আসুন, ভিতরে আসুন!
আমরা তিনজন বাড়ির নাম লেখা সাদা কাঠের গেট খুলে ভিতরে এগিয়ে গেলাম। ভদ্রলোক এককালে বেশ সুপুরুষ ছিলেন, সেটা দিনের আলোতে দেখে বুঝতে পারছি। দেখে অসুস্থ বলে মনেই হয় না। মিঃ মজুমদারের সঙ্গে আর একজন ভদ্রলোক বেরিয়ে এসেছিলেন, জানলাম। তিনিই হলেই সেক্রেটারি রজত বসু। খয়েরি ট্রাউজারের উপর গাঢ় নীল পোলো-নেক পুলোভার পরেছেন, মাঝারি হাইট, রং বেশ পরিষ্কার।
আমাদের বৈঠকখানায় নিয়ে গেলেন মিঃ মজুমদার। আমরা ভাগাভাগি করে দুটো সোফায় বসলাম। ঘরের এক পাশে একটা কাচের আলামারিতে গুচ্ছের ছোট-বড় রুপের কাপ সাজানো রয়েছে। বোঝা যায় সেগুলো মিঃ মজুমদার নানান সময়ে নানান স্পোর্টস প্রতিযোগিতাতে পেয়েছেন। মাটিতে একটা লেপার্ডের ছাল, আর দেয়ালে দুটো হরিণ আর একটা বাইসনের মাথাও দেখলাম।
আজ সন্ধ্যায় আমার ছেলে সমীরণ আসবে, বললেন বিরূপাক্ষ মজুমদার। ‘বাপ-ছেলের মধ্যে কোনও মিল খুঁজে পাবেন বলে মনে হয় না। সে ব্যবসাদার, শেয়ার মার্কেটে ঘোরাঘুরি করে।
তিনি কি ছুটিতে আসছেন, না কোনও কাজে?
সাতদিনের ছুটিতে। অন্তত বলছে তো তাই, তবে ও চুপচাপ বসে ছুটি ভোগ করার ছেলে নয়। ভয়ানক ছটফট। ত্রিশ হতে চলল, এখনও বিয়ে করেনি। আর কবে করবে জানি না। যাকগে—এখন আপনাদের কথা বলুন!
আমরা বরং আপনার কথা শুনতে এসেছি, বলল ফেলুদা।
আমার কথার তো শেষ নেই বললেন মিঃ মজুমদার। আই হ্যাভ লেড এ ভেরি কালারফুল লাইফ। অবিশ্যি পরের দিকে সেটল করে গিয়েছিলাম। একটা ব্যাঙ্কের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে আমার ঘাড়ে। স্বভাবতই তখন অনেকটা সামলে নিতে হয়। তরুণ বয়সটা-শুধু তরুণ কেন, প্রায় চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত-খুব হই-হুন্নোড় করেছি। খেলাধুলো, আউটডোর-ইনডোর, শিকার, কিছুই বাদ দিইনি ।
আর তার সঙ্গে আপনার কাটিং জমানোর হবি ৷
হ্যাঁ, সেটা কখনও বাদ পড়েনি। রজত আপনাকে একটা নমুনা দেখিয়ে দেবে।
ভদ্রলোক সেক্রেটারির দিকে ইঙ্গিত করাতে তিনি উঠে গিয়ে ভিতরের ঘর থেকে একটা মোটা বড় খাতা এনে ফেলুদার হাতে দিলেন। আমি আর লালমোহনবাবু উঠে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়ালাম।
বিচিত্র খাতা, তাতে সন্দেহ নেই।
আপনি দেখছি লন্ডনের কাগজ থেকেও কাটিং রেখেছেন, বলল ফেলুদা।