আমরা কথা বলতে বলতে এগিয়ে গিয়েছিলাম ম্যালের মুখে ফোয়ারাটা ছাড়িয়ে মেন রোডের দিকে। মিঃ মজুমদার বললেন, আমার একটা ওষুধ ফুরিয়ে গেছে, কেনা দরকার। চলুন না। ওই কেমিস্টের দোকানে।
আমরা গিয়ে দোকানে ঢুকলাম। ভদ্রলোক টিফানিল নামে রাংতায় মোড়া একত্ৰিশটা বড়ি কিনলেন। বললেন, এ হল অ্যান্টি-ডিপ্রেসান্ট পিলস্—আমার এক মাসের স্টক। রোজ একটি করে না খেলে আমার ঘুম হয় না।
দোকান থেকে বেরিয়ে এসে ফেলুদা বলল, এক’দিন গিয়ে আপনার খাতাগুলো একটু দেখব।
একশোবার বললেন ভদ্রলোক।ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম। এও আপনাকে দেখিয়ে দেব যে, এখনও কিনারা হয়নি এমন পুরনা তদন্তের খবরও আমার খাতায় সাঁটা আছে। আমি বলছি প্ৰায় বিশ বছর আগের কথা।
খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো। বলল ফেলুদা।
অবিশ্যি আমার নিজের জীবনটাও কম ইন্টারেস্টিং নয়, বললেন ভদ্রলোক। এক এক সময় ইচ্ছে করে আত্মজীবনী লিখি, কিন্তু তার পরেই মনে হয়—সবগুলো সত্যি কথা তো লিখতে পারব না। আত্মজীবনী লিখতে গেলে কোনও কিছুই গোপন রাখা উচিত নয়। অন্তত আমার তাই বিশ্বাস। যাক গে—এক’দিন আসবেন।
কোন সময় গেলে আপনার ব্যাঘাত হবে না?
দ্য বেস্ট টাইম ইজ ইন দ্য মর্নিং। আমি বিকেলে একটু ঘুরতে বেরোই। মাউন্ট এভারেস্ট হোটেল ছাড়িয়ে একটু গেলে বাঁয়ে একটা রাস্তা পাবেন যেটা পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে উঠে গেছে। সেটা দিয়ে কিছু দূর গেলেই দেখবেন, গেটে নয়নপুর ভিলা লেখা একটা বাগানে ঘেরা বাংলো। সেটাই আমার বাড়ি।
ভদ্রলোক হাত তুলে গুড বাই করে এগিয়ে গিয়ে একটা ঘোড়ায় চাপলেন, সঙ্গে একজন সহিস। ফেলুদা বলল, রুগি মানুষ, খাড়াই ওঠা বারণ, তাই নিশ্চয়ই ঘোড়া ব্যবহার করেন। তবে বেশ লোক, তাতে সন্দেহ নেই।
শুটিং পার্টির সকলে এ-দোকান সে-দোকান ঘুরে দেখছে, পুলকবাবু এগিয়ে এসে বললেন, মজুমদার মশাইকে কেমন লাগল?
খুব ভাল, বলল ফেলুদা।অসুখ হলে কী হবে, এখনও বেশ তাজা আছেন।
আর সব ব্যাপারে ইন্টারেস্ট। শুটিং-এর বিষয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করছিলেন।
উনি ছাড়া আর কে থাকেন ওঁর বাড়িতে?
ওর সেক্রেটারি আছেন, রজত বোস। এ ছাড়া জনা তিনেক চাকর, মালী আর সহিংস আছে। ভদ্রলোক বিপত্নীক। ওঁর ছেলে আসছেন কলকাতা থেকে। অন্তত আসার তো কথা। একটিই ছেলে। মেয়ে আছে দুটি, তাদের বিয়ে হয়ে গেছে। তারা কলকাতায় থাকে না।
ভদ্রলোকের হবিটা কিন্তু খুব চিত্তাকর্ষক।
কাটিং জমানোর কথা বলছেন?
হ্যাঁ। অনেকটা আমাদের সিধুজ্যাঠার কথা মনে পড়ছে।
আমারও যে তা মনে হয়নি তা নয়, তবে সিধুজ্যাঠা শুধু খুনখারাপির খবরই জমান না; ইন্টারেস্টিং খবর হলেই সেটা সেঁটে রাখেন।
কথা আর বেশি দূর এগোল না। পুলকবাবু বললেন শুটিং-এর অনেক তোড়জোড় আছে, এবার হোটেলে ফিরতে হবে। আগামীকাল নাকি খুব হালকা আউটডোরের কাজ রাখা হয়েছে; তার পরদিন থেকে আর্টিস্ট নিয়ে কাজ শুরু হবে, আর প্রথমেই বিরূপাক্ষ মজুমদারের বাড়িতে কাজ।
দোকানের খোলা ছাতে বসে। হট চকোলেট খেলাম। লালমোহনবাবু খুব তৃপ্তি সহকারে চকোলেটে চুমুক দিয়ে বললেন, মশাই, আমার মন কিন্তু একটা কথা বলছে।
কী বলছে?
বলছে এ যাত্রা বৃথা যাবে না।
বৃথা কেন যাবে? দাৰ্জিলিং-এ এসেছি। চেঞ্জে, এমন চমৎকার ক্লাইমেট, বৃথা কখনও যেতে পারে? পালিউশন-ফ্রি আবহাওয়া—শরীর সারতে বাধ্য।
আমি সেদিক দিয়ে বলছি না, একটা বিজ্ঞ হাসি হেসে বললেন জটায়ু।
তবে কোন দিকে দিয়ে বলছেন?
আমি আপনার পেশার কথা ভাবছি।
আমার পেশা?
আমার মন কেন জানি বলছে যে, আপনাকে কাজে লেগে পড়তে হবে।
ফেলুদা একটা চারমিনার ধরিয়ে বলল, আসলে মুশকিলটা করছে আমার পেশা নয়, আপনার পেশা। আপনার স্বভাবই হল অলিতে-গলিতে রহস্যের গন্ধ পাওয়া। অবিশ্যি যদি তেমন কিছু ঘটেই বসে, গড ফরবিড়, তা হলে ফেলুমিত্তির হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না এটা এই তো চাই!
এই তো এ. বি. সি. ডি.-র পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত মনোভাব!
এইখানে বলে রাখি, এ. বি. সি. ডি. হল ফেলুদাকে দেওয়া লালমোহনবাবুর খেতাব। এর মানে হল এশিয়াজ ব্রাইটেস্ট ক্রাইম ডিটেক্টর। কাজেই উনি ফেলুদাকে মাঝে মাঝে এ. বি. সি. ডি. বলে সম্বোধনও করে বসেন।
আমি জানি না, কিন্তু বিরূপক্ষ মজুমদারের সঙ্গে যেটুকু আলাপ হল, তাতে আমারও ভদ্রলোককে বেশ রহস্যজনক চরিত্র বলে মনে হল। বছরের পর বছর প্রায় একাই দার্জিলিং-এ পড়ে আছেন। খাতায় গরম গরম খবর সাঁটছেন, আর পুরনো খবর পড়ে দেখছেন; অবিশ্যি তার মানেই যে তাকে ঘিরে কোনও ক্রাইম ঘটবে, সেটা ভাবার কোনও যুক্তি নেই। আসল কথাটা হচ্ছে কী-ফেলুদা চেঞ্জে গেলেও সেখানে শেষ পর্যন্ত তাকে গোয়েন্দার ভূমিকা নিতে হয়, এটা এতবার দেখেছি যে, মন বলছে এবারও সেটা না হয়ে যায় না।
দেখা যাক, কপালে কী আছে।
০৩. সাব্লাইম কথাটা
সাব্লাইম কথাটা লালমোহনবাবুকে এই প্রথম ব্যবহার করতে শুনলাম। অবিশ্যি শুধু সাব্লাইম নয়, তার সঙ্গে স্বগীয়, হেভেনলি, অপার্থিব অনির্বাচনীয় ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহার করে এথিনিয়াম ইস্কুলের কবি মাস্টার বৈকুণ্ঠ মল্লিকের লেখা একটি ছ। লাইনের কবিতা আবৃত্তি করে ফেললেন ভদ্রলোক। ঘটনা আর কিছুই না, দ্বিতীয় দিন ভোরে উঠে। ভদ্রলোক তাঁর ঘরের জানালায় দাঁড়িয়েই দেখেন যে সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে, আর তাতে সবে সূর্যের গোলাপি রঙের ছোপ পড়তে শুরু করেছে। সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক আমাকে ঘুম থেকে তুলে এনে তার পাশে দাঁড় করালেন। বললেন, এ জিনিস কারুর সঙ্গে শেয়ার না করলে মজাই নেই। আর তার পরেই বিশেষণের তোড়, আর সব শেষে উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করা কবিতা–~