আই সি, খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে বললেন মিঃ ভার্মা! যাই হোক, মিঃ মিত্তিরের অবজারভেশন যে দারুণ শার্প, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
ফেলুদার পর্যবেক্ষণ শক্তির পরীক্ষা অবিশ্যি দাৰ্জিলিং-এ খুব ভালভাবেই হয়েছিল, কিন্তু সে কথা, যাকে বলে, যথাস্থানে বলব। আপাতত প্লেন এসে গেছে, আমাদের ডাক পড়ে গেছে, তাই উঠে পড়তে হল। এখন সিকিউরিটি খুব কড়া, আমি জানি ফেলুদা তাই তার কোপ্ট রিভলভারটা সুটকেসে চালান দিয়েছে, সেটা ইতিমধ্যে আমাদের অন্য মালের সঙ্গে প্লেনে উঠে গেছে। আজকাল ফেলুদা আর কোনও রিস্ক নেয় না; স্রেফ ছুটি ভোগ করতে গিয়েও তাকে এত বার তদন্তে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে যে, ও রিভলভার ছাড়া কোথাও যায় না।
সিকিওরিটি থেকে লাউঞ্জে গিয়ে বসার দশ মিনিটের মধ্যেই ডাক পড়ল-দ্য ফ্লাইট টু বাগডোগরা ইজ রেডি ফর ডিপারচার। আমরা তিনজন আর সেই সঙ্গে শুটিং-এর দল, প্লেনে গিয়ে উঠলাম। এখন আমরা সমতল ভূমিতে, কিন্তু আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই উঠে যাব ৬০০০ ফুট উঁচুতে। অক্টোবরে দাৰ্জিলিং-এ বেশ ঠাণ্ডা, ভাবতেই মনটা নোচে উঠছে। আমি যেন দেখতে পাচ্ছি যে সামনে অ্যাডভেঞ্চার আছে, যদিও সেটা ফেলুদাকে বলায় ও দাবিড়ানি দিয়ে বলে দিল, তার কোনও ইঙ্গিত এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, কাজেই তোর
আশা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
এর পরে আর আমি ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু বলতে যাইনি।
০২. কাঞ্চনজঙ্ঘা হোটেল
কাঞ্চনজঙ্ঘা হোটেলটা দিব্যি ছিমছাম। ঘরে ঘরে টেলিফোন, হিটার, স্নানের ঘরে ঠাণ্ডা-গরম জলের ব্যবস্থা, বিছানার চাদর, বালিশ পরিষ্কার-মোট কথা সব কিছু দেখে মনটা যাকে বলে বেশ প্রসন্ন হয়ে গেল। দিন দশেকের জন্য এসেছি, তাই থাকার ব্যবস্থাটা মোটামুটি ভাল না। হলে মনটা খুঁতখুঁত করে।
পথে কোনও উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি। সোনাদা এলে পর লালমোহনবাবু তাঁর রাজস্থান থেকে কেনা। কান-ঢাকা চামড়া আর পশমের টুপিটা মাথায় চাপিয়ে নিলেন। পথের দুধারে পাহাড়ের দৃশ্য দেখে উনি কতবার যে বা বলেছেন, তার হিসেব নেই। শেষটায় কার্সিয়ং রেলওয়ে রেস্টোরান্টে চা খাবার সময় ভদ্রলোক সত্যি কথাটা বলে ফেললেন। সেটা হল এই যে, তিনি এই প্রথম দাৰ্জিলিং-এ চলেছেন।
ফেলুদার চোখ কপালে উঠে গেল।
সে কী আপনি এখনও কাঞ্চনজঙ্ঘাই দেখেননি?
নো সার। একগাল হেসে জিভ কেটে বললেন লালমোহনবাবু।
ইস্—আপনাকে প্রচণ্ড হিংসে হচ্ছে।
কেন?
প্রথমবার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার যে কী অদ্ভুত অনুভূতি, সেটা তো আমাদের মধ্যে একমাত্র আপনিই বুঝবেন! ইউ আর ভেরি লাকি, মিস্টার গাঙ্গুলী।
আকাশ পরিষ্কার থাকলে কার্সিয়ং থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়, কিন্তু আজ মেঘলা। ঘুম যখন পৌঁছলাম তখন আলো পড়ে আসছে, আর তখনও মেঘ কাটেনি? মোট কথা লালমোহনবাবুর ভাগ্যে ব্যাপারটা এখনও ঘটেনি। এটা অবিশ্যি দাৰ্জিলিং-এর বিখ্যাত ঘটনা। এমনও হতে পারে যে এই দশ দিনের এক দিনও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাবে না। তা হলে অবিশ্যি খুবই খারাপ হবে। আমি নিজে এর আগে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে থাকলেও আবার নতুন করে দেখার জন্য উদ্গ্ৰীব হয়ে আছি। এই একটা দৃশ্য, যা কোনও দিনও পুরনো হবার নয়।
হোটেলে জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখে আমরা তিনজনে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের হোটেল থেকে মিনিট পাঁচেক খাড়াই উঠেই ম্যাল। যখন পীছলাম, তখন দোকানের আর রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। লালমোহনবাবু বললেন, কী ব্যাপার মশাই, গাড়িটাড়ি দেখছি না কেন? ফেলুদাকে বুঝিয়ে দিতে হল, দাৰ্জিলিং-এর বেশ খানিকটা অংশে গাড়ি চলা নিষিদ্ধ। ম্যালটা হল সে রকম একটা জায়গা। এখানে শুধু হাঁটা চলে আর ঘোড়ায় চড়া চলে। আপনি ঘোড়ায় চড়েছেন কখনও? জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
নাঃ, বললেন লালমোহনবাবু। তবে উটেই যখন চড়া আছে, তখন ঘোড়া তো তার কাছে নস্যি।
আগেই বলেছি যে বিরূপাক্ষ মজুমদার বলে একজনের বাড়িতে শুটিং হবার কথা আছে।
আশ্চর্য এই যে, প্রথম দিনই ম্যালে এসে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল! সেটা হল। পুলক ঘোষালের মারফত। শুটিং পার্টি ম্যালে বেড়াতে বেরিয়েছে, পুলক ঘোষাল একবার আগেই দাৰ্জিলিং এসে বিরূপাক্ষ মজুমদারের বাড়ি দেখে পছন্দ করে গেছেন, ভদ্রলোকও কোনও আপত্তি করেননি। ফেলুদাকে দেখেই পুলকবাবু এগিয়ে এলেন, তাঁর সঙ্গে একজন ফেল্ট হ্যাঁট আর সুট পরা ভদ্রলোক।
এঁর বাড়িতেই আমরা শুটিং করছি, বললেন পুলকবাবু, ইনি হলেন মিস্টার বিরূপাক্ষ মজুমদার।
তার পর পুলকবাবু আমাদের তিন জনের পরিচয় দিয়ে দিলেন ভদ্রলোককে। আপনার সঙ্গে শুটিং-এর কী সম্পর্ক? ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করলেন মিঃ মজুমদার। ফেলুদা বলল, আমার কোনও সম্পর্ক নেই, তবে আমার এই বন্ধুটি একজন বিখ্যাত রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক। এরই একটি গল্প থেকে ছবিটা হচ্ছে।
বাঃ, ভেরি গুড! ইনি ক্রাইম রাইটার, আর আপনি গোয়েন্দা—ভেরি গুড! প্ৰদোষ মিত্র নামটা তো জানা বলে মনে হচ্ছে। আপনার নাম তো কাগজে বেরিয়েছে কয়েকবার, তাই न्म?
আজ্ঞে হ্যাঁ, বলল ফেলুদা।গত বছর বাসপুকুরে একটা খুনের ব্যাপারে আমি কিছুটা সাহায্য করেছিলাম।
দ্যাট্স রাইট, বলে উঠলেন ভদ্রলোক, তাই চেনা চেনা লাগছিল। আমার আবার একটা বাতিক আছে; আমি খবরের কাগজের খবর সংগ্ৰহ করি। আমার সতের বছর বয়স থেকে এই হবি। সব খবর নয়, যাকে বলা যায় একটু গরম খবর। একত্ৰিশটা খণ্ড হয়েছে সেই খবরের খাতার। এখন তো রিটায়ার করেছি; মাঝে মাঝে সেই সমস্ত পুরনা খাতার পাতা উলটে উলটে দেখি। লোকে গল্পের বই পড়ে, আর আমি পুরনা খবর পড়ি। এখন অবিশ্যি আমার একজন হেলপার হয়েছে। রজত—আমার সেক্রেটারি-আমার কাটিংগুলো খাতায় সেঁটে দেয়। আপনার কাটিংও আছে তার মধ্যে।