রজতবাবু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন।
ফেলুদা আবার তার কথা শুরু করল।
এর মধ্যে গতকাল আবার একটা ঘটনা ঘটে। একজন লোক কুয়াশার মধ্যে আমাকে খাদে ফেলে মারতে চেষ্টা করে।
সমস্ত ঘর চুপ। সকলেই ফেলুদার দিকে চেয়ে আছে। ফেলুদা বলে চলল—
লোকটিকে ভাল করে দেখা যায়নি কুয়াশার জন্য, তবে তার চাপ দাড়িটা যে কৃত্রিম, সেটা সন্দেহ করেছিলাম। সে লোকটি যখন আমাকে ঠেলা মারে তখন আমি একটা সেন্টের গন্ধ পাই। সেটা ছিল। ইয়াৰ্ডলি ল্যাভেন্ডার এবং সে গন্ধ আমি আরেকবার একজনের গায়ে পেয়েছিলাম।–দমদম এয়ারপোর্টে রেস্টোরান্টে বসে।
এখানে হঠাৎ রাজেন রায়ন কথা বলে উঠল।
আমি নিজে ইয়ার্ডলি ল্যাভেন্ডার ব্যবহার করি, কিন্তু মিস্টার মিত্তির যদি বলেন যে আমি ছাড়া সে সেন্ট কেউ ব্যবহার করে না, তা হলে তিনি অত্যন্ত ভুল করবেন।
ফেলুদার ঠোঁটের কোণে হাসি।
আপনি যে এ কথা বলবেন তা আমি জানতাম, বলল ফেলুদা। কিন্তু আমার কথা বলা তো এখনও শেষ হয়নি, মিঃ রায়না।
বলুন কী বলবেন।
ফেলুদা এবার সাহার কাছ থেকে একটা পোর্টফোলিও নিয়ে তার ভিতর থেকে একটা খাম বার করল। আর সেই সঙ্গে একটা বাঁধানো ছবি। এটা সেই বেঙ্গল ব্যাঙ্কের গ্রুপ ফোটো।
এই গ্রুপ ছবিটার কথা কি আপনার মনে আছে, মিঃ রায়না?
আই হ্যাভ নেভার সিন ইট বিফোর।
কিন্তু এতে যে আপনি নিজে উপস্থিত রয়েছেন।
মানে?
এইবার ফেলুদা খাম থেকে একটা ছবি বার করল। এটা একটা মুখের এনলার্জমেন্ট।
এই ছবিটার উপর আমার একটু কলম চালাতে হয়েছে, বলল ফেলুদা, কারণ তখন আপনার দাড়ি ছিল না, এখন হয়েছে। দেখুন তো এঁকে চিনতে পারেন কিনা। এটা বেঙ্গল ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের ভি. বাল্যাপেরিয়ার ছবি।
রায়না আর হাতে নিয়ে ছবিটা দেখল না। সে একটা রুমাল বার করে ঘাম মুছছে। আমি দেখতে পাচ্ছি। ছবিটার সঙ্গে রায়নার হুবহু সাদৃশ্য।
যাঁর বাড়িতে আপনার শুটিং হবে তিনি যে আপনার এককালের বস, এবং তিনি যে আপনাকে চিনে ফেলবেন এটা আপনি কী করে জানবেন? আর, একবার যদি সত্য কথা প্রকাশ পেয়ে যায় তা হলে সেই কলঙ্কের চাপে আপনার ফিল্ম কেরিয়ারের কী দশা হবে সেটা তো। আপনি বুঝতেই পারছিলেন। মিঃ মজুমদার আপনাকে জানিয়েছিলেন যে তিনি আপনাকে চিনতে পেরেছিলেন। আপনি অস্বীকার করেন। তাতে তিনি বলেন, ইউ আর এ লায়ার! আর তারপর বাংলায় বলেন, আমি তোমার একটা কথাও বিশ্বাস করি না। আপনি এগারো বছর বেঙ্গল ব্যাঙ্কে চাকরি করেন, কাজেই আপনি বাংলা যথেষ্ট ভাল ভাবেই জানতেন।
আর খুনের সুযোগের কথাই যদি হয়, তা হলো লাঞ্চের সময় পঁয়তাল্লিশ মিনিট কাজ বন্ধ ছিল; সেই ফাঁকে মিঃ মজুমদারের ঘরে যাওয়া আপনার সম্ভব ছিল; আর মিঃ মজুমদার যখন আপনাদের তাঁর বালগোপালকে দেখাতে নিয়ে যান, তখন তার পাশেই যে একটি ভুজালি রয়েছে সেটা নিশ্চয়ই আপনার দৃষ্টি এড়ায়নি।
সাহা এবার রায়নার দিকে রওনা দিলেন। পুলক ঘোষাল মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। তাঁর মনের কী অবস্থা সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছি। লালমোহনবাবু এবার আমার দিকে ঝুকে পড়ে ফিসফিস করে বললেন, কিন্তু মজুমদার বিষ কথাটা কেন লিখলেন–
লালমোহনবাবুর কথা শেষ হল না, কারণ ফেলুদা আবার মুখ খুলেছে। সে বলল—
আমি আরও বলছি, মিঃ রায়না। মিঃ মজুমদারকে যখন আপনি খুন করতে যান, তখন তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। তিনি আপনাকে দেখেছিলেন। ছুরির আঘাতের পরও তিনি কয়েক মুহূর্ত বেঁচে ছিলেন। কারণ ছুরি ঠিক, মোক্ষম জায়গায় লাগেনি। মিঃ মজুমদার আপনার নামটা লিখে যেতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পুরোটা লিখতে পারেননি। সে নামটা কী আপনি বলবেন?–রায়না চুপ।
আমি বলি?
রায়না চুপ।
আমরা খবর নিয়ে জেনেছি যে, ভি বাল্যাপোরিয়া হচ্ছে বিষ্ণুদাস বাল্যাপেরিয়া। বিষ্ণুদাসের বিষ-টুকু মজুমদার লিখতে পেরেছিলেন, আর পারেননি।
আই অ্যাম সরি, আই অ্যাম সরি! বলে ডুকরে কেঁদে উঠলেন বিষ্ণুদাস বাল্যাপেরিয়া ওরফে রাজেন রায়না।
ফেলুদা এবার সমীরণবাবুর দিকে চাইল। সমীরণবাবু বললেন, আমি তো এদের কাছে শিশু!
তা বটে, বলল ফেলুদা।এবার সুটকেসটা খুলুন তো দেখি; খুলে অষ্টধাতুর বালগোপালটা বার করে দিন।
বিকেলে কেভেনটারসের ছাতে বসে কথা হচ্ছিল। আমরা তিনজন আর পুলক ঘোষাল।
দাৰ্জিলিংটা বড় অপয়া জায়গা, লালুদা, বললেন পুলক ঘোষাল। তার চেয়ে ভাবছি, সিমলায় করব শুটিং-টা। রাজেন রায়নার জায়গায় অর্জুন মেরহাত্ৰা। কেমন মানাবে?
দুর্দান্ত, বললেন লালমোহনবাবু। তবে আমার অংশটা বাদ পড়বে না তো!
পাগল!—নভেম্বরেই শুটিং আরম্ভ করে ফেলব, আর ফেব্রুয়ারিতে শেষ। আরও চারখানা ছবি আছে আমার হাতে, সব এইটি সেভেনের মধ্যে নামিয়ে দিতে হবে।
চারখানা ছবি! পর পার?
তা আপনাদের আশীর্বাদে মোটামুটি চলছে ভালই, লালুদা!
ফেলুদা লালমোহনবাবুর দিকে ফিরে বলল, এঁকেও তা হলে এ বি সি ডি বলা চলে, তাই না?
কীরকম? চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করলেন জটায়ু।
এশিয়াজ বিজিয়েস্ট সিনেমা ডাইরেক্টর।