আমরা আরও এগিয়ে চললাম। এবার আর নয়নপুর ভিলা দেখা যাচ্ছে না। একটা মাত্র পাখির ডাক কিছুক্ষণ থেকে কানে আসছে, কিন্তু সেটা যে কী পাখি তা জানি না।
উত্তর দিকে চোখ পড়াতে হঠাৎ দেখি মেঘ সরে গিয়ে দুটো পাইন গাছের মধ্যে দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার খানিকটা অংশ দেখা যাচ্ছে। আমি লালমোহনবাবুকে সেই দিকে দেখতে বলব বলে ভাইনে ঘুরেই দেখি ভদ্রলোক চোখ বড়-বড় করে থমকে দাঁড়িয়ে গেছেন। কী দেখছেন ভদ্রলোক?
ওঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে পুবে চাইতেই বুঝলাম ব্যাপারটা কী।
একটা গাছের গুড়ির পাশে একটা ঝোপ, আর সেই ঝোপের পিছনে এক জোড়া জুতো-পরা পা দেখা যাচ্ছে।
এগিয়ে গিয়ে দেখবে? ফিসফিসে গলায় জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু।
আমি এ প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গেলাম। ওই জুতা জোড়া আমি আগে দেখেছি।
ঝোপটা পেরোতেই ব্যাপারটা বুঝলাম।
একটা লাশ পড়ে আছে মাটিতে।
একে আমরা চিনি।
এ হল লোকনাথ বেয়ারা।
একেও বুকে ছুরি মেরে খুন করা হয়েছে, যদিও অস্ত্রটা কাছাকাছির মধ্যে নেই।
তার বদলে আছে একটা পাথরের সামনে একটা ভাঙা বাতল, আর সেই বাতলের চারিদিকে ছড়ানো গোটা ত্ৰিশোক বড়ি। সেই বাড়ি এককালে সাদা ছিল, কিন্তু এখন জল আর মাটি লেগে সেটা আর সাদা নেই।
আমরা আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে সোজা ফিরে এলাম হোটেলে। ফেলুদাও বলল সে ফিরেছে মিনিট পাঁচেক আগে। লালমোহনবাবু সেনসেশনাল ব্যাপার— বলে নাটক করতে আরম্ভ করেছিলেন। আমি ওঁকে থামিয়ে এক কথায় ব্যাপারটা বলে দিলাম।
ফেলুদা তৎক্ষণাৎ থানায় ফোন করে দিল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সাহাকে নিয়ে দুটো জিপ চলে এল, একটায় চারজন কনস্টেবল।
আমরা আবার ফিরে গেলাম ঝাউবনে যেখানে লাশ পাওয়া গিয়েছিল, সেই জায়গায়।
ইনিও দেখছি ছুরিকাঘাতে মৃত্যু, বললেন সাহা।আসলে আমরা খুঁজছিলাম লোকালয়ে, ভাবছিলাম লোকটা কোনও গোপন ডেরায় লুকিয়ে রয়েছে। এই ডিসকভারির জন্য পুরো ক্রেডিট পাবেন মিস্টার মিত্তিরের বন্ধু এবং কাজিন! সত্যিই আপনারা কাজের কাজ করেছেন।
মৃতদেহ চলে গেল পুলিশের জিন্মায়, আমরা ফিরে এলাম হোটেলে।
এ যে মোড় ঘুরে গেল! আমাদের ঘরে এসে খাটের উপর ধাপ্ত করে বসে বললেন লালমোহনবাবু!
ঘুরেছে ঠিকই, বলল ফেলুদা, কিন্তু অন্ধকারের দিকে নয়, আলোর দিকে। এখন শুধু কয়েকটা খবরের অপেক্ষা। তারপর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি।
সন্ধ্যায় এল ফেলুদার টেলিফোন-সাহার কাছ থেকে। একপেশে কথা শুনে, আর ফেলদুর গোটা বিশেক হ্যাঁ, আই সি আর ভেরি গুড) শুনে আন্দাজ করলাম যে, খবরটা যা আসবার তা এসে গেছে। শেষে ফেলুদা বলল, তা হলে কাল সকাল দশটার সময় সকলকে বলুন যেন মিঃ মজুমদারের বৈঠকখানায় জমায়েত হয়। নয়নপুর ভিলার সকলে এবং মাউন্ট এভারেস্টের পুলক ঘোষাল, রাজেন রায়না, মহাদেব ভার্মা আর ক্যামেরাম্যান সুদেব ঘোষ। আপনাদের উপস্থিতি তো অবশ্যই এসেনশিয়াল।
১১. এশিয়াজ বিজিয়েস্ট সিনেমা ডাইরেক্টর
পরদিন সকাল সাতটায় আমাদের হোটেলের ঘরের ফোনটা বেজে উঠল। আমরা দুজনেই আগেই উঠে পড়েছিলাম, সবে বেড-টি খাওয়া হয়েছে, ফেলুদা বিছানায় বসেই হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলল। ওকে শুধু দুটো কথা বলতে শুনলাম—বলেন কী! আর আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে নিচ্ছি।
ফোনটা রেখে আমার দিকে ফিরে বলল, লালমোহনবাবুকে বল তৈরি হয়ে নিতে—এক্ষুনি!
কী ব্যাপার, কোথায় যাওয়া হচ্ছে? সেটা পুলিশের জিপে উঠে বুঝলাম। আজ সক্কাল সক্কাল পুলিশের জিপ নয়নপুর ভিলায় গিয়েছিল ওদের মিটিং সম্বন্ধে খবর দিতে। গিয়ে শুনল সমীরণবাবু নাকি একটা জরুরি টেলিফোন পেয়ে পনের মিনিট আগে শিলিগুড়ি রওনা হয়ে গেছেন। অথচ ফেলুদার মতে মিটিং-এ তাঁকে ছাড়া চলবে না।
পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে এই স্পিডে কোনও দিন চলেছি বলে মনে পড়ে না। দেখতে দেখতে ঘুম সোনাদা টুং ছড়িয়ে গেল। তবু ভাগ্যি ভাল এখন অবধি তেমন কুয়াশা পাইনি। নইলে জিপের স্পিড তোলা যেত না। অসম্ভব তুখোড় ড্রাইভার, তাই পঁয়তাল্লিশ মিনিটের রাস্তা আধা ঘণ্টায় পেরিয়ে গেল।
সাহা অবিশ্যি কার্সিয়ং আর শিলিগুড়িতেও খবর পাঠিয়ে দিয়েছিলেন যাতে সমীরণবাবুর গাড়ি তারা আটকায়। কিন্তু ট্যাক্সির নম্বরটা দেওয়া সম্ভব হয়নি। সেটা বার করতে বেশ কিছুটা সময় নষ্ট হয়ে যেত।
কার্সিয়ং পর্যন্ত গিয়েও সমীরণবাবুর ট্যাক্সির কোনও পাত্তা পাওয়া গেল না। সাহা ড্রাইভারকে বললেন, এবার পাংখাবাড়ির শর্টকাটটা ধরো।
আমাদের দুটো জিপ ছিল; একটা সাধারণ রাস্তা দিয়ে গেল, আর অন্যটা—যাতে আমরা g য়ছি–সেটা শর্টকাটটা ধরল।
পাংখাবাড়ির রাস্তা যে কী ভয়ানক প্যাঁচালো, সেটা যে না দেখেছে তাকে বোঝানো অসম্ভব। লালমোহনবাবু তো চোখ বন্ধ করে রইলেন। বললেন, অন্য গাড়ির দেখা পেলে বোলো, তপেশ। আমি তার আগে আর চোখ খুলছি না; খুললেই গা গুলোবে।
পনের মিনিট সাপের মতো প্যাঁচানো উতরাই দিয়ে যাবার পর একটা হেয়ারপিন বেন্ড ঘুরেই দেখা গেল একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার প্রায় মাঝামাঝি। বাঝাই যাচ্ছে টায়ার পাংচার। গাড়ির পাশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অসহিষ্ণুভাবে সিগারেট টানছেন সমীরণ মজুমদার।
আমাদের জিপ দেখেই ভদ্রলোক কেমন যেন হকচাকিয়ে তটস্থ হয়ে পড়লেন।
আমরা সকলেই গাড়ি থেকে নামলাম। ফেলুদা আর সাহা এগিয়ে গেল সমীরণবাবুর দিকে। ভদ্রলোকের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।