থাকতে পারি।
সেই ভাল; ফিল্ম পার্টির সঙ্গে অতিরিক্ত মাখামাখিটা আমার পছন্দ হয় না। দার্জিলিং-এ ইদানীং অনেক নতুন হোটেল হয়েছে। তার একটাতে থাকলেই হল।
আমি বললাম, হোটেল কাঞ্চনজঙ্ঘার একটা বিজ্ঞাপন দেখেছি কাগজে।
ঠিক বলেছিস, বলল ফেলুদা। আমিও দেখেছি।
তা হলে আর কী, বললেন লালমোহনবাবু, ব্যবস্থা করে ফেললেই হয়।
ব্যবস্থা তিন দিনের মধ্যেই হয়ে গেল।
বিষ্যুদবার ত্ৰিশে সেপ্টেম্বর দুপুরে এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখি, আমাদের সঙ্গে পুলক ঘোষালও চলেছেন। আর সে-সঙ্গে চলেছে ছবির হিরো, হিরোইন আর ভিলেন। লালমোহনবাবুর গল্পে কোনও হিরোইন ছিল না; সেটা বুঝলাম এঁরা ঢুকিয়েছেন। পুলক ঘোষাল ফেলুদাকে দেখে এক গাল হেসে বললেন, লালুদার গল্প হওয়াতে আবার আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ভেরি লাকি। তবে আশা করি, আগের বারের মতো এবারও আপনাকে তদন্তে জড়িয়ে পড়তে হবে না।
পুলক ঘোষাল হিরো রাজেন্দ্র রায়না, হিরোইন সুচন্দ্ৰা আর ভিলেন মহাদেব ভার্মার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। সুচন্দ্রাকে দেখতে ভাল, তবে রং একটু বেশি মেখেছেন, রাজেন রায়নার ছবি আমি আগেই দেখেছি।–বেশ স্মার্ট, হাসিখুশি ভদ্রলোক, একটু দাড়ি আছে বেশ ছোট করে আর যত্ন করে ছাঁটা, লম্বায় ফেলুদাররি মতো, আর শরীরটাকেও বেশ ফিট বলেই মনে হল। ইনি নবাগত হলেও বয়স অন্তত চল্লিশ তো হবেই; তবে সেটা মেক-আপ নিলে ক্যামেরায় আর ধরা পড়বে বলে মনে হয় না। লালমোহনবাবু ওঁর হিরো প্রখর রুদ্রের যে বর্ণনা দিয়েছেন-লিস্বয় সাড়ে ছ। ফুট, পঞ্চাশ ইঞ্চি ছাতি, খাঁড়ার মতো নাক, আর চোখ দেখলে মনে হয় যেন আগুন জ্বলছে—সে-রকম চেহারার কোনও অভিনেতা কোনও দেশে আছে বলে আমার জানা নেই।
আমার সবচেয়ে ইস্টারেস্টিং লাগল। মহাদেব ভার্মাকে। ইনি হলেন যাকে ইংরেজিতে বলে পালিশ করা ভিলেন। চোখ দুটো ঢুলু ঢুলু, ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি, ন্যাকের নীচে সরু চাড়া-দেওয়া গোঁফ, দেখে মনে হয় প্রয়োজনে খুন করতে কিছুমাত্র দ্বিধা করবেন না। তার উপর দেখলাম ভদ্রলোক পারফিউম ব্যবহার করেছেন, তাতে বোঝা যায় ইনি শৌখিনও বটে। পারফিউম অবিশ্যি রাজেন্দ্র রায়নাও মেখেছেন, তবে তার গন্ধ অন্য। ফেলুদা পরে বলেছিল যে মহাদেব ভার্মাির সেন্টটা হচ্ছে ড়েনিম, আর প্লায়নারটা হল ইয়ার্ডলি ল্যাভেন্ডার।
এয়ারপোর্টেই লাউড স্পিকারে বলল যে বাগডোগরার প্লেন এক ঘণ্টা লেট আছে। তাই আমরা সকলেই রেস্টোরান্টে চা-কফি খেতে চলে গেলাম। এ ব্যবস্থাটা অবিশ্যি পুলক ঘোষালই করলেন, আর আমরা তাঁর অতিথি হয়েই গেলাম।
রেস্টোরান্টে মহাদেব ভার্মার সঙ্গে ফেলুদার কথা হল। আমি ফেলুদার পাশেই বসেছিলাম, তাই সব কথাই শুনতে পেলাম।
ফেলুদাই প্রথম শুরু করল, বলল, আপনি তো বোধহয় কয়েক বছর হল এ লাইনে এসেছেন?
ভার্মা বললেন, হ্যাঁ, সবে তিন বছর হয়েছে। তার আগে আমার ছিল ভ্ৰমণের নেশা। ভারতবর্ষের বহু জায়গায় ঘুরেছি; এমনকী বছর পাঁচেক আগে লে-লাদাক পর্যন্ত ঘুরে এসেছি। সেখান থেকে যাই কাশ্মীর। শ্ৰীনগরে একটা শুটিং হচ্ছিল, সেই ছবির পরিচালকের সঙ্গে ঘটনাচক্ৰে পরিচয় হয়; তিনিই আমাকে ছবিতে আফগার দেন। এখন অবিশ্যি আর ফিল্ম ছাড়ার কথা ভাবাই যায় না।
লালমোহনবাবু কিছুক্ষণ থেকেই উসখুসি করছিলেন, এবার তাঁর প্রশ্নটা করে ফেললেন।
আপনি যে চরিত্রটা করছেন, সেটা আপনার কেমন লাগল?
খুব জোরদার চরিত্র, বললেন মহাদেব ভার্মা।বিশেষ করে আমি যেখানে হিরোইনকে আমার সামনে ধরে হিরোর প্রতি বাক্যবাণ নিক্ষেপ করছি, আর হিরো হাতে রিভলভার নিয়েও কিছু করতে পারছে না, সে দৃশ্যটা সত্যি নাটকীয়।
অবিশ্যি এমন কোনও দৃশ্য বইয়ে নেই। লালমোহনবাবুর মুখের হাসিটা তাই কেমন যেন শুকিয়ে গেল।
এবার মহাদেব ভার্মা ফেলুদাকে একটা প্রশ্ন করলেন।
আপনি তো গোয়েন্দা বলে শুনলাম। তা গোয়েন্দারা তো শুনেছি, একজন মানুষকে দেখেই তার বিষয়ে অনেক কিছু বলে দিতে পারেন। আপনি আমাকে দেখে কিছু বলুন তো দেখি।
ফেলুদা হেসে বলল, গোয়েন্দারা অবশ্যই জাদুকর নন। তাঁরা যেটুকু বোঝেন তার কিছুটা পর্যবেক্ষণের জোরে, আর কিছুটা মনস্তত্ত্বের সাহায্যে। এ দুটোর ভিত্তিতে এটুকু বলতে পারি যে আপনি কিছুটা নিরাশ বাধ করছেন।
কেন?
কারণ আপনি প্রায়ই কথা বলতে বলতে এদিক-ওদিক দেখছেন আর বেশ বুঝতে পারছেন যে, এই লোক-ভর্তি রেস্টোরান্টে আপনাকে অনেকেই চিনতে পারছে না। একটু আগেই লক্ষ করলাম যে, আপনি চারপাশে চোখ বুলিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অথচ হিরো রাজেন্দ্র রায়নাকে অনেকেই চিনেছে, অনেকেই এগিয়ে এসে তার অটাগ্রাফ নিয়েছে। শেষে দেখলাম, আপনি আপনার কালো চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রাখলেন, যদি তার ফলে কেউ চেনে; কিন্তু তাতেও কোনও ফল হল না দেখে আপনি আবার চশমাটা পরে নিলেন।
মহাদেব ভার্মা এবার আর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আপনি হাভূড পারসেন্ট ঠিক বলেছেন। বম্বেতে আমাকে পাবলিক প্লেসে দেখলে রীতিমতো হই-চই পড়ে যায়। আপনাদের বাঙালিরা বোধহয় বেশি হিন্দি ছবি দেখেন না।
যথেষ্ট দেখেন, বললেন লালমোহনবাবু, কিন্তু আপনার তিনখানা ছবি এখনও এখানে রিলিজ হয়নি। অবিশ্যি আমি যে সিনেমার খুব খবর রাখি তা নয়, তবে আমার গল্পে যিনি ভিলেনের পার্ট করছেন, তাঁর বিষয়ে গত ক দিনে কিছু খোঁজ-খবর নিচ্ছিলাম ফিল্ম পত্রিকাগুলো থেকে।