একটা শেলফের উপর একটা বাঁধানো ছবি টাঙানো ছিল। একটা গ্রুপ ছবি; দেখে মনে হয় আপিসের গ্রুপ, সবসুদ্ধ জনা পয়ত্রিশ লোক, কিছু পিছনের সারিতে দাঁড়িয়ে, বাকি সামনের চেয়ারে বসে।
ও ছবিটা বেঙ্গল ব্যাঙ্কে তোলা, বললেন রজতবাবু। একজন ম্যানেজিং ডিরেক্টর চলে যাচ্ছিলেন, তাঁকে ফেয়ারওয়েল দেবার দিন ছবিটা তোলা হয়েছিল। মিঃ মজুমদার তখন ডেপুটি ডিরেক্টর ছিলেন।
ফেলুদা ছবিটা হাতে নিয়ে মন দিয়ে দেখল।
কোনজন কে-সেটা লেখা নেই ছবিতে? মিঃ মজুমদারকে তো চিনতেই পারছি।
ছবির তলার দিকে থাকতে পারে। হয়তো বাঁধানোর সময় মাস্কেল্প নীচে ঢাকা পড়ে গেছে।
এটা আমার কাছে দু-তিন দিন রাখতে পারি?
নিশ্চয়ই।
ফেলুদা ছবিটা আমার হাতে চালান দিল। আমি আর লালমোহনবাবু সেটা দেখলাম। আপিসের গ্রুপ যেমন হয় তেমনই ব্যাপার। মিঃ মজুমদার প্রথম সারিতে চেয়ারে বসে আছেন বোধহয় ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পাশে।
ফেলুদা বলল, খুনের দিন সকালবেলা আপনি কখন কী করছিলেন সেটা জানা দরকার।
প্রশ্নটা করে ফেলুদা কোটের পকেট থেকে তার খাতাটা বার করে একটা পাতা খুলে তাতে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর বলল, সাড়ে এগারোটার সময় মিঃ মজুমদার তাঁর স্টাডিতে আসতেন। তখন আপনার তাঁর সঙ্গে থাকতে হত। সাড়ে বারোটা পর্যন্ত কাজ চলত, তাই না?
হ্যাঁ।
সেদিন কী কাজ ছিল?
মিঃ মজুমদারের অনেক চেনা পরিচিত ছিল দেশ-বিদেশে। উনি তাঁদের নিয়মিত চিঠি লিখতেন। তাতেই বেশির ভাগ সময় কেটে গেছিল সেদিন।
সাড়ে এগারোটার আগে সকালে আপনি কী করছিলেন?
ব্রেকফাস্টের কিছু পরেই শুটিং-এর দল আসতে শুরু করে। আমি দক্ষিণের বরান্দায় গিয়ে ওদের তোড়জোড়ের কাজ দেখছিলাম।
কোনও শট নেওয়া দেখছিলেন?
প্রথমটা দেখেছিলাম। মিঃ গাঙ্গুলী আর মিঃ ভার্মাকে নিয়ে শট।
লালমোহনবাবুর মাথা নাড়া দেখে বুঝলাম, তিনি রজতবাবুর কথাটার সমর্থনা করছেন।
সেটা কটা নাগাত?
আন্দাজ এগারোটা। আমি ঘড়ি দেখিনি। তার কিছু পরেই আমি মিঃ মজুমদারের কাজের ঘরে চলে আসি।
কাজের পর তো লাঞ্চ খেতেন আপনারা?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আপনারা তিনজনে এক সঙ্গে খেতেন?
হ্যাঁ।
খাওয়ার পর কী করেন?
লাঞ্চ শেষ হয় প্রায় একটার সময়। তারপর আমি নিজের ঘরে এসে কিছুক্ষণ বই পড়ি।
কী বই?
বই না, পত্রিকা। রিডারস ডাইজেস্ট।
তারপর?
তারপর দুটো নাগাত একটু ঝাউবনে ঘুরতে বেরেই। ঝাউবনটা খুব সুন্দর। আমি ফাঁক পেলেই ও দিকটা একবার ঘুরে আসি।
তারপর?
আড়াইটে নাগাত আমি ফিরে আসি। তারপর বিকেল চারটে অবধি বিশ্রাম করে আর একবার শুটিং দেখতে যাই। তখন মিঃ গাঙ্গুলীর একটা শট হচ্ছিল।
লালমোহনবাবু আবার মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
ফেলুদা বলল, মিঃ মজুমদার যখন পাঁচটার পরেও ঘর থেকে বেরোলেন না। তখন আপনার কোনও প্রতিক্রিয়া হয়নি?
আমি ঘড়ি দেখিনি! বাড়িতেহট্টগোল, জেনারেটর চলছে, আমার সময়ের খেয়াল ছিল না।
মিঃ মজুমদার বস হিসেবে কী রকম লোক ছিলেন।
খুব ভাল।
আপনার উপর চোটপাট করেননি কখনও?
না।
মাইনে যা পেতেন, তাতে আপনি খুশি ছিলেন?
হ্যাঁ।
খুনের আগের দিন লালমোহনবাবু দুপুরের দিকে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে মিঃ মজুমদারের গলা শুনতে পান। তিনি কাউকে বলছিলেন, ইউ আর এ লায়ার। আমি তোমার একটা কথাও বিশ্বাস করি না।–এই কথাটা উনি কাকে বলতে পারেন, সে ধারণা আছে আপনার?
একমাত্র ওঁর ছেলে ছাড়া আর কারুর কথা তো মনে পড়ছে না।
ওঁর ছেলের সঙ্গে মিঃ মজুমদারের সপ্তাব ছিল না?
ছেলের সম্বন্ধে কতকগুলো ব্যাপারে ওঁর আক্ষেপ ছিল।
সেটা আপনি কী করে জানলেন?
আমার সামনে দু-একবার বলেছেন—সমুটা বড় রেকলেস হয়ে পড়ছে-ঝ ওই জাতীয় কথা। উনি ছেলেকে ভালও বাসতেন, আবার সেই সঙ্গে শাসনও করতেন।
উনি কোনও উইল করে গেছেন বলে আপনি জানেন?
যদ্দুর জানি করেননি।
কেন বলছেন এ কথা?
কারণ এক’দিন আমাকে বলেছিলেন—এখন তো দিব্যি আছি; আরেকটু শরীরটা ভাঙুক, তারপর উইল করব।
তার মানে ওঁর সম্পত্তি ওঁর ছেলেই পাচ্ছেন?
তই তো হয়ে থাকে।
এবার আপনার ঘরটা একবার দেখতে পারি কি?
আসুন।
রজতবাবুর শোবার ঘরে আসবাবপত্র খুবই কম। একটা খাট, একটা ছোট আলমারি, একটা তাক, একটা টেবিল আর একটা চেয়ার ( দেয়ালে আলনা রয়েছে একটা, তাতে একটা শর্ট, একটা খয়েরি পুলোভার আর একটা তোয়ালে ঝুলছে। ঘরের একপাশে একটা সুটকেস রয়েছে, তাতে আর বি লেখা।
টেবিলের উপর তিন-চারখানা ইংরিজি পেপার ব্যাক আর গোটা পাঁচেক পত্রিকা রয়েছে।
হিন্দি পত্রিকা দেখছি যে? ফেলুদা প্রশ্ন করল।
আমার ছেলেবেলা কানপুরে কেটেছে, বললেন রজতবাবু, বাবা ওখানকার ডাক্তার ছিলেন। ইস্কুলে হিন্দি শিখেছিলাম। বাবা মারা যাবার পর কলকাতায় মামা বাড়িতে চলে আসি।
আমরা চারজন ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ফেলুদা প্রশ্ন করল, মিঃ মজুমদার ঘুমের আগে একটা বড়ি খেতেন, সেটা আপনি জানতেন?
হ্যাঁ। আমি অনেকবার গিয়ে সে বড়ি এনে দিয়েছি। টফ্রানিল। পুরো মাসের স্টক একবারে কিনে নিতেন।
ই.এবার একটু সমীরণবাবুর সঙ্গে কথা বলব।
সমীরণবাবু স্নান সেরে তাঁর ঘরে বসে একটা খবরের কাগজ পড়ছিলেন। অশৌচ অবস্থা, তাই দাড়ি কামাননি ভদ্রলোক। ওঁর সঙ্গে কথা বলে খুব বেশি কিছু জানা গোল না। ভদ্রলোক স্বীকার করলেন যে ওঁর বাপের সঙ্গে মাঝে মাঝে কথা কাটাকাটি হত। বাবা আগে এ রকম ছিলেন না, বললেন ভদ্রলোক।অসুখের পর থেকে এ রকম হয়ে গিয়েছিলেন।