ঘটনাচক্ৰে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে, বলল ফেলুদা!
ভদ্রলোক তো আমারই পেশেন্ট ছিলেন, বললেন ডাঃ বর্ধন।
তাই বুঝি?
ইয়েস। আশ্চর্য মনের জোর ছিল মিঃ মজুমদারের। দেখে বোঝাই যেত না যে ওঁর ওপর দিয়ে এত ঝড় বয়ে গেছে, এবং এখনও যাচ্ছে। নিজের হবি নিয়ে মেতে থাকতেন, আর ঘোড়া চড়ে ঘুরে বেড়াতেন।
কিন্তু ঝড়ের কথা কী বলছেন একটু জানতে পারি কি?
একে তো ওঁর নিজের অসুখ ছিল। তারপর স্ত্রীকে হারান বছর সাতেক আগে। ভদ্রমহিলার ক্যানসার হয়েছিল। তার উপর পুত্রের সমস্যা।
সমীরণবাবুর কথা বলছেন?
এত গুণ ছিল ছেলেটির, কিন্তু শেয়ার বাজারের খেলা খেলতে গিয়ে সব গেছে। এখন দেনার জালে জড়িয়ে পড়েছে; একটিমাত্র ছেলে, তাই ভাবতে কষ্ট হয়। আমি তো ওঁর ডাক্তার ছিলাম, তাই সুখ-দুঃখের অনেক কথাই আমাকে বলতেন। এবারও যে ছেলে এসেছে, আই অ্যাম শিওর তার কারণ বাপের কাছে হাত পাতা। কিন্তু আমি যতদূর জানি বাবা সম্প্রতি ছেলের উপর রীতিমতো বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন। একটা আলটিমেটাম দিয়ে থাকলেও আশ্চর্য হব না। সমস্ত ব্যাপারটা কালিমাময়, আনপ্লেজেন্ট। আমার ভাল লাগছে। না। খুনের কথাটা শুনে অবধি আমার মনে একটা আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমি সেটা কাটিয়ে উঠতে পারছি না।
ভদ্রলোক উইল করে গেছেন কি না জানেন?
তা জানি না। তবে করে থাকলে ছেলেকেই নিশ্চয় সব কিছু দিয়ে গেছেন—যদি না ইতিমধ্যে উইল বদলে থাকেন।
ফেলুদা ডাঃ বর্ধনকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে উঠে পড়ল। অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও ভদ্রলোক একটি পয়সাও নিলেন না। আসবার সময় ফেলুদা বলল, আপনি যে আমার কত উপকার করেছেন, তা আপনি জানেন না। ফাস্ট এন্ড নিতে এসেছিলাম, তার সঙ্গে আরও অনেক এত পেয়ে গেলাম!
বাইরে বেরিয়ে এসে ফেলুদা বলল, তোরা যদি বিশ্রাম করতে চাস তো হোটেলে ফিরে যেতে পারিস। আমি কিন্তু এখন একটু নয়নপুর ভিলায় যাব। আজকের জানা সব নতুন তথ্য মাথায় রেখে নতুন করে তদন্ত শুরু করতে হবে। আমার চোখে কেসটা এখন একেবারে নতুন চেহারা নিয়েছে।
আমরাও দুজনেই অবিশ্যি সঙ্গেই যেতে চাইলাম। ও যদি এত ধকলের পরও বিশ্রাম ছাড়া চলতে পারে তা হলে আমরা তো পারবই। সত্যি, আশ্চর্য শক্ত শরীর ফেলুদার। পাহাড়ের গা গড়িয়ে প্রায় একশো ফুট নীচে চলে গিয়েছিল।
আমরা নয়নপুর ভিলায় যখন পৌঁছলাম তখন কুয়াশা প্রায় কেটে গেছে। সমস্ত বাড়িটায় একটা থমথমে ভাব, যদিও চারিদিকের আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য যেমন ছিল তেমনই আছে। নুড়ির ওপর আমাদের পায়ের শব্দ শুনেই বোধহয় রজতবাবু ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। ফেলুদা তাঁকে নমস্কার জানিয়ে বলল, আপনার যে হাত খালি খালি লাগছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি। আমাদের কতকগুলো কাজ ছিল, সেই ব্যাপারে আপনি যদি আমাদের একটু সাহায্য করেন…
কী কাজ বলুন।
আমরা একবার মিঃ মজুমদারের কাজের ঘরটা দেখতে চাই। তারপর আপনার ঘরটাও একটু দেখব। অবিশ্যি তার সঙ্গে কিছু প্রশ্নও করতে হবে।
বেশ তো, চলুন।
সমীরণবাবুকে দেখছি না–?
উনি বোধহয় স্নান করতে গেছেন।
তা হলে চলুন মিঃ মজুমদারের স্টাডিতেই বসা যাক্।
আমরা চারজনে বাড়ির উত্তর দিকের পিছনের অংশে একটা ঘরে গিয়ে হাজির হলাম। বেশ সুসজ্জিত, পরিষ্কার ঘর, পুবের জানালা দিয়ে বাড়ির পিছনের ঋউবন দেখা যায়। জানালার সামনে একটা বেশ বড় মেহগনি টেবিল, তার পিছনে একটা আর সামনে দুটো ভারী চেয়ার; এ ছাড়া, ঘরের পশ্চিম অংশেও আলাদা বসবার ব্যবস্থা রয়েছে। একটা সোফা আর দুটো মুখোমুখি আর্ম চেয়ার। আমরা সেখানেই বসলাম! ফেলুদার বসবার তাড়া নেই, সে ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। টেবিলের উপর থেকে পেপারকাটার তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল।
এটায় তো বেশ ধার দেখছি, বলল ফেলুদা, এই দিয়েও তো মানুষ খুন করা যায়।
লালমোহনবাবু বললেন, ওর একটা জোড়া নাকি ওঁদের শুটিং-এ ব্যবহার হচ্ছে। এটা দিয়ে ভিলেনকে পিঠ চুলকোতে দেখানো হয়েছে।
সত্যিই ছুরিটাকে দেখলে বেশ ধারালো মনে হয়। ফেলুদা সেটা আবার টেবিলের উপর রেখে দিল।
ঘরের এক দিকে একটা বুক-শেলফে সারি সারি বড় খাতা দাঁড় করানো রয়েছে, তার দুটো আমরা এর আগেই দেখেছি। এগুলোতেই সেই সব খুনখারাবির খবর সাঁটা আছে। ফেলুদা তার আরও দু-একটা উলট-পালটে দেখল। তারপর প্রশ্ন করল, আপনি আসার আগে এগুলো কে সাঁটত?
মিঃ মজুমদার নিজেই।
আপনি আসার পর থেকে তো উনি সে কাজটা আপনার উপরই ছেড়ে দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, তবে আমাকে লোকনাথ মাঝে মাঝে সাহায্য করত।
লোকনাথ বেয়ারা?
হ্যাঁ। লোকনাথ স্কুল ফাইনাল পাশ করেছে। সে রীতিমতো লিখতে-পড়তে পারে।
এটা একটা অপ্রত্যাশিত খবর। তবে, পড়াশুনা করে সে বেয়ারার কাজ কোন নিল, সেটা বলতে পারেন?
মিঃ মজুমদার ওকে খুব ভাল মাইনে দিতেন।
আর সে বেয়ারাই শেষকালে এমন একটা কাজ করল?
ফেলুদা ঘুরে ঘুরে এটা সেটা দেখছে আর প্রশ্ন করে চলেছে।
আপনি এখানে আসার আগে কী করতেন?
একটা দিশি ফর্মে চাকরি করতাম?
কোথায়?
কলকাতায়।
ক বছর করেছিলেন এই কাজ?
সাত বছর।
মিঃ মজুমদার কি সেক্রেটারি চেয়ে বিজ্ঞাপন দেন?
হ্যাঁ। আপনি কদ্দূর পড়েছেন?
আমি বি কম পাশ।
আপনার ফ্যামিলি নেই?
আমি বিয়ে করিনি। বাবা-মা মারা গেছেন।
ভাই-বোন নেই?
না।
তার মানে আপনি একা মানুষ?
হ্যাঁ।
এই ছবিটা কী ব্যাপার?