হরিনারায়ণবাবুর সঙ্গে আমরাও উঠে পড়লাম। ফেলুদার কপালে নতুন করে ভূকুটি দেখা দিয়েছে। আমার মন বলছে এবার আর কেসটিকে তেমন সহজ বলে মনে হচ্ছে না। ফেলুদার। খানিকটা পথ কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হেঁটে ও বলল, এই কাহিনী আমার চিন্তাকে সাহায্য করবে না ব্যাহত করবে। সেটা বুঝতে পারছি না। এখন এই শহরের অবস্থা যেমন, আমার মনের অবস্থাও ঠিক সেই রকম। একরাশ কুয়াশা এসে চিন্তাশক্তিকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। যদি একটু সূর্যের আলো দেখতে পেতাম!
আমরা হাঁটতে হাঁটতে অবজারভেটরি হিল রোডের পুব দিকটায় এসে পড়লাম। বুঝতে পারছিলাম ফেলুদার মনের ভিতরটা ছটফট করছে, তাই সে এক জায়গায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।
কুয়াশার মধ্যেই একজন নেপালি একটা ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে এল, পিঠে কোনও সওয়ার নেই।বাবু ঘোড়া লেগা, ঘোড়া? বলে উঠল লোকটা, কিন্তু আমরা তাকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে গেলাম। সামনে বাঁয়ে ঘুরে গেছে রাস্তাটা, ডাইনে খাদ, আমরা সে খাদ বাঁচিয়ে রাস্তার বা দিক ঘেঁষে চলেছি। রাস্তার পাশের রেলিংটা প্ৰায় দেখা যাচ্ছে না। কুয়াশায়। পরিষ্কার দিনে এখন থেকে সামনে উত্তরে পুরো কাঞ্চনজঙ্ঘার লাইনটা দেখা যায়; আজ আমাদের চার দিক থেকে ঘিরে রয়েছে একটা দুর্ভেদ্য সাদা দেয়াল।
এবার পাশের রেলিংটা ফুরিয়ে গেছে। এখন ডাইনে রাস্তার ধারেই খাদ। আমরা এখনও পাহাড়ের দিক ঘেঁষে চলেছি, যদিও দেখছি ফেলুদা, মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে একটু বেশি ডান দিকে চলে যাচ্ছে। লালমোহনবাবু খালি বলছেন, মিস্টিরিয়াস, মিস্টিরিয়াস…। তারপর একবার বললেন, মশাই, মিস্ট থেকেই মিষ্ট্রি আর মিস্টিরিয়াস এসেছে নাকি?
হঠাৎ আমাদের পিছনে ফিরতে হল, কারণ দ্রুত পায়ের শব্দ পেয়েছি। কিন্তু কই, এখনও তো কাউকে দেখা যাচ্ছে না! অথচ পায়ের শব্দটা এগিয়ে আসছে। তারপর হঠাৎ কুয়াশার ভিতর থেকে একটা ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল। তার মুখ ভাল করে দেখার আগেই সে মূর্তি ফেলুদাকে সজোরে মারল একটা ধাক্কা খাদের দিকে। ফেলুদা টাল সামলাতে না পেরে পাহাড়ের গা দিয়ে গড়িয়ে মুহূর্তের মধ্যে নীচে অদৃশ্য হয়ে গেল-চারিদিক কুয়াশায় কুয়াশা!
ইতিমধ্যে মূর্তিও আবার কুয়াশায় মিলিয়ে গেছে, সেই সঙ্গে মিলিয়ে গেছে তার দ্রুত পায়ের শব্দ।
লালমোহনবাবুর আর্তনাদের সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম কী সাংঘাতিক একটা ঘটনা ঘটে গেল।
আর সেই সঙ্গে দুটো নেপালি সামনের কুয়াশা থেকে বেরিয়ে এল, আর আমাদের দেখেই জিজ্ঞেস করল, কেয়া হুয়া, বাবু?
আমরা বললাম কী হয়েছে। আমাদের সঙ্গের লোক খাদে পড়ে গেছে জেনেই তারা দুজন অনায়াসে পাহাড়ের গা দিয়ে নীচে নেমে গেল—এক মিনিট ঠাহরিয়ে বাবু, হাম দেখতা হ্যায় কেয়া হুয়া।
লোক দুটোও কুয়াশার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল, কিন্তু সেই মুহূর্তেই কুয়াশাও হঠাৎ পাতলা হয়ে চারদিকে সব কিছু যেন আবছা আবছা দেখা যেতে লাগল। কে যেন একটা ফিন্ফিনে চাদর টেনে সরিয়ে নিচ্ছে সমস্ত দৃশ্যের উপর থেকে।
নীচে ওটা কী?
একটা গাছ। রডোডেনড্রন বলেই তো মনে হচ্ছে। তার গুঁড়ির সঙ্গে লেগে একটা মানুষ পড়ে আছে। ফেলুদা! ওই যে তার খাকি জার্কিন আর লাল-কালো চেক্ মাফলার।
নেপালি দুটো মুহূর্তের মধ্যে পাহাড়ের গা দিয়ে নেমে গেছে, তার পর ফেলুদাকে দু হাতে ধরে তুলতেই যেন ফেলুদারও হুঁশ ফিরে এসেছে।
ফেলুদা?
ফেলুবাবু!
আমাদের দুজনের ডাকের উত্তরে ফেলুদা তার ডান হাতটা তুলে আশ্বাস দিল যে সে ঠিকই আছে।
তারপর সে খাড়াই দিয়ে উঠে এল দুই নেপালির সাহায্যে-আমাদের চরম বিপদের সময় দুই আচমকা বন্ধু।
পাঁচ মিনিটের কসরত ও চেষ্টার পর ফেলুদা পৌঁছে গেল আমাদের কাছে—সে হাঁপাচ্ছে, তার কপাল ছড়ে গিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে, হাতেও আঁচড় লেগেছে, তাতে রক্তের আভাস।
বহুৎ সুক্ৰিয়া! ফেলুদা বলল তার উদ্ধারকারীদের।
তারা দুজনে চাপড় মেরে ফেলুদার গা থেকে ধুলো ঝেড়ে দিয়ে বলল, ম্যালের মোড়েই ডাক্তণরখানা আছে, সেখানে এক্ষুনি গিয়ে যেন ফেলুদা ফাস্ট এডের ব্যবস্থা করে।
আমাদেরও সে মতলব ছিল। আমরা হাঁটা দিলাম আবার ম্যালের দিকে।
লোকটা কে ছিল বুঝতে পারলে তপেশ? লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন। আমি মাথা নাড়লাম। সত্যি বলতে কী, চাপ দাড়ি ছাড়া আর কিছুই দেখিনি আমি। আর দাড়িটাও মনে হচ্ছিল নকল।কী রকম বোধ করছেন? জটায়ু জিজ্ঞেস করলেন ফেলুদাকে।
বিধ্বস্ত, বলল ফেলুদা। ওই গাছটাই আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে, না হলে হাড়গোড় সব চুরমার হয়ে যেত। কিন্তু মনে হচ্ছে, এবার আস্তে আস্তে মাথা খুলে যাবে। একটা জোরালো কুঁ তো এর মধ্যেই পেয়েছি। আমার এ রকমই হয়, জানেন, এ রকমই হয়। এটার দরকার ছিল। আর এটাও বুঝলাম যে, কেসটা মোটেই সরল নয়।
০৯. ফেলুদার জখম
ফেলুদার জখম যে তেমন গুরুতর হয়নি সেটা ডাক্তারখানায় গিয়েই বোঝা গেল। ডাক্তার বর্ধন বসেন ডিসপেনসারিতে, তিনিই ফাস্ট এন্ড দিয়ে দিলেন। ভদ্রলোক স্বভাবতই ঘটনাটা জানতে চাইলেন, আর আমাদেরও বলতে হল।
কিন্তু আপনার ওপর এ আক্রমণের কারণ কী? জিজ্ঞেস করলেন বর্ধন।
এর ফলে ফেলুদাকে নিজের পরিচয় দিতে হল। তাতে ভদ্রলোকের চোখ কপালে উঠে গেল! বললেন, আপনিই স্বনামধন্য গোয়েন্দা প্রদোষ মিত্ৰ? আমি তো আপনার অনেক কীর্তির বিষয়ে পড়েছি মশাই! চাক্ষুষ পরিচয় যে হবে সেটা কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।..কিন্তু আপনি কি মিঃ মজুমদারের খুনের তদন্ত করছেন নাকি?