সাহা চলে গেলেন, কিন্তু ফেলুদার কপালে দুশ্চিন্তার রেখা রয়েই গেল। ও শেষে বলল, একটা সামান্য সহজ জিনিস নিয়ে এত ভাবার কোনও মানেই হয় না। লোকনাথকে খুঁজে বার করবে পুলিশ; সেখানে আমার কিছু করারই নেই। চল, একটু বেড়িয়ে আসি ম্যালে।
আজকের দিনটা কুয়াশাচ্ছন্ন, তার ফলে শীতটাও একটু বেশি, তাই বোধহয় ম্যালে বেশি লোক নেই। আমরা তিনজন এগিয়ে একটা খালি বেঞ্চিতে বসলাম।
ভারী অদ্ভুত লাগছে কুয়াশার মধ্যে ম্যালটাকে। এতই কুয়াশা যে দশ হাত দূরের লোককে দেখা যায় না। কাছে এলে মনে হয়। হঠাৎ যেন শূন্য থেকে বেরিয়ে এল। সেই ভাবেই বেরিয়ে এলেন একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক, আর তিনি এগিয়ে এলেন আমাদের দিকেই। তারপর ফেলুদার দিকে চেয়ে হাত দুটো জোড় করে বললেন, নমস্কার!
০৮. পরিচয় হয়েছিল আমাদের
পরিচয় হয়েছিল আমাদের—আপনার মনে আছে বোধহয়?
হ্যাঁ হ্যাঁ—আপনার নাম তো হরিনারায়ণ মুখোপাধ্যায়?
বাঃ, আপনার মেমরি তো বেশ শার্প দেখছি। তা, একটু বসতে পারি আপনাদের পাশে?
নিশ্চয়ই।
ফেলুদা ওর নিজের আর লালমোহনবাবুর মাঝখানে একটু জায়গা করে দিল। ভদ্রলোক বসলেন।
আপনি তো নয়নপুর ভিলার পাশেই থাকেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ। উত্তর দিকের বাড়িটা আমার। আমি আছি। এখানে প্ৰায় এগারো বছর।
আপনার বাড়ির পাশেই তো একটা ট্র্যাজিডি হয়ে গেল।
তা তো বটেই, বললেন ভদ্রলোক। কিন্তু এর একটা আঁচ তো আগে থেকেই পাওয়া গোসূল, তাই নয় কি?
আপনার তাই মনে হয়?
এ কথা বলছি, কারণ বিরূপাক্ষ মজুমদারকে আমি অনেক দিন থেকেই চিনি। ঘনিষ্ঠ আলাপ ছিল বলতে পারি না, কারণ মজুমদার যে খুব মিশুকে লোক ছিলেন তা নয়। কিন্তু তাঁর বিষয়ে আমি জানি অনেক দিন থেকেই।
কী করে জানলেন?
আমি এককালে বছর দশেক ছিলাম মধ্যপ্রদেশের নীলকণ্ঠপুরে। আমার পেশা ছিল জিওলজি। ইট পাথর নিয়ে কারবার ছিল আমার। সেই নীলকণ্ঠপুরে একবার আসেন। বিরূপক্ষ মজুমদার। তখন ওঁর বয়স ছিল হয়তো পয়ত্রিশ-ছত্রিশ। শিকারের খুব শখ ছিল ভদ্রলোকের। নীলকণ্ঠপুরের রাজা পৃথ্বী সিং মজুমদারকে আমন্ত্রণ জানান তাঁর জঙ্গলে গিয়ে শিকার করার জন্য। পরস্পর আলাপ ছিল আগে থেকেই! এই দুই শিকারির মধ্যে একটা মিল ছিল। সেটা এই যে, কেউই মাচার উপর থেকে শিকার করতে চাইতেন না। এমনকী হাতির পিঠ থেকেও না। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল বিটারদের সাহায্য না নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সোজা হেঁটে গিয়ে বাঘ শিকার করা। এই শিকার থেকেই হয় এক চরম দুৰ্ঘটনা।
কী রকম?
বাঘের বদলে মানুষের উপর গুলি চালান বিরূপাক্ষ মজুমদার।
সে কী!
ঠিকই বলছি।
মানে, কোনও স্থানীয় অধিবাসী-টাসী–?
না। তা হলে তো তবু কথা ছিল। যিনি মরেছিলেন, তিনি ছিলেন ভদ্রলোক এবং বাঙালি। নাম সুধীর ব্রহ্ম। বাঙালি হলেও বাপের আমল থেকে মধ্যপ্ৰদেশবাসী। পেশা ছিল নীলকণ্ঠপুর রাজ কলেজে ইতিহাসের প্রফেসারি, কিন্তু প্রচণ্ড শখ ছিল কবিরাজির। রাজা এবং মজুমদার যে সময় বাঘ খুঁজছিলেন, সেই সময় ব্ৰহ্ম ঘুরছিলেন জঙ্গলে গাছড়ার অনুসন্ধানে। তাঁর গায়ে একটা গেরুয়া চাদর ছিল। একটা ঝোপের পাতা নড়তে দেখে আর ঝোপের ফাঁক দিয়ে গেরুয়া দেখে বাঘ ভেবে গুলি চালান বিরূপাক্ষ মজুমদার। সে গুলি গিয়ে লাগে সুধীর ব্রহ্মের পেটে। তৎক্ষণাৎ মৃত্যু।
এ খবর যাতে না ছড়ায়, তার জন্য বিস্তর টাকা খরচ করতে হয়েছিল পৃথ্বী সিং-কে। আমি নিজে জানি, কারণ আমি ছিলাম। ব্রহ্মের বন্ধুস্থানীয়। মজুমদার কলঙ্কের হাত থেকে পার পায় ঠিকই, কিন্তু সে যে অপরাধী, সে যে হত্যকারী, বাঘ মারতে সে যে মানুষ মেরে ফেলেছিল, তাতে তো কোনও সন্দেহ নেই। এই অপরাধের বোঝা বয়ে মানুষ কত দিন বেঁচে থাকতে পারে?
আপনার কি মনে হয় এবার যে-খুন হয়েছে তার সঙ্গে এই দুর্ঘটনার কোনও যোগ আছে?
একটা ব্যাপার আছে। আপনি গোয়েন্দা, আপনি হয়তো বর্তমানে হত্যা নিয়ে ভাবছেন, তাই আপনাকে বলছি। সুধীর ব্ৰহ্মর একটি ছেলে ছিল, নাম রমেন ব্ৰহ্ম। এই দুর্ঘটনা যখন ঘটে তখন ছেলেটির বয়স ষোলো। সে কিন্তু এই ধামা চাপা দেওয়ার ব্যাপারটাকে মোটেই বরদাপ্ত করতে পারেনি। আমাকে কাকা বলে সম্বোধন করত। রমেন। সেই সময়ই সে বলেছিল যে বড় হয়ে সে এই হত্যার প্রতিশোধ নেবে। এখন তার বয়স হওয়া উচিত আটত্রিশ।
আপনার সঙ্গে সে যোগাযোগ রেখেছিল?
না। আমি নীলকণ্ঠপুর ছাড়ি আজ থেকে বিশ বছর আগে। কিছুকাল ছোট নাগপুরে ছিলাম। তারপর রিটায়ার করে চলে আসি দাৰ্জিলিং-এ। আমার বাড়িটা আপনার চোখে পড়েছে কিনা জানি না। ছোট্ট কটেজ বাড়ি; আমি আর আমার স্ত্রী থাকি; আমার একটি ছেলে, সে কলকাতায় প্লিন্ডার; একটি মেয়ের বিয়ে হয়ে বাইরে রয়েছে।
আপনার কি ধারণা, সুধীর ব্রহ্মের সেই ছেলে এখন এখানে রয়েছে?
তা বলতে পারব না; আর বাইশ বছর পরে তাকে দেখলে হয়তো চিনতেও পারব না। কিন্তু সে বাপের হত্যার প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর ছিল সে কথা আমি জানি।
ভদ্রলোক যে ঘটনাটা বললেন, সেটা যে খুবই আশ্চর্য তাতে কোনও সন্দেহ নেই। এটা বুঝতে পারছিলাম যে, এ কাহিনী ফেলুদাকে নতুন করে ভাবাবে।
ফেলুদা বলল, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। সে ছেলে যদি এখন এখানে নাও থাকে, মিঃ মজুমদারের জীবনে যে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে এটা শুনে খুবই অবাক লাগছে। তাঁর জীবনে যে কোনও একটা গোলমেলে ব্যাপার ঘটেছিল সে রকম ইঙ্গিত দু-একবার পেয়েছি, এমনকী আপনিও দিয়েছেন, কিন্তু সেটা যে এমন একটা ঘটনা তা ভাবতে পারিনি। আর আপনি নিজেই যখন সে সময় নীলকণ্ঠপুরে উপস্থিত ছিলেন, তখন এটা অবিশ্বাস করার কোনও কারণ থাকতে পারে না।