রজতবাবু তাকে কোথাও পাঠাননি তো?
না। উনি কিছু জানেনই না। বললেন, দুপুরের খাবার পর আধা ঘণ্টা বিশ্রাম করেই উনি ঝাউবনে বেড়াতে যান। এটা ওঁর একটা বাতিক আছে। উনি দুপুরে ঘুমোন না।
কথাটা যে সত্যি সেটা জানি। কারণ শুটিং-এ লঞ্চ ব্রেকের সময় আমি একবার ঝাউবনে গিয়েছিলাম ছোট কাজ। সারতে। তখন রজতবাবু ঝাউবন থেকে ফিরছিলেন।
এই লোকনাথ বেয়ারা কতদিনের? জিজ্ঞেস করলেন সাহা।
বছর চারেক, বললেন সমীরুণবাবু! আগের বেয়ার রঙ্গলাল খুব পুরনো লোক ছিল। সে হঠাৎ হেপাটাইটিসে মারা যায়। লোকনাথ খুব ভাল রেফারেন্স নিয়ে এসেছিল। একটু লিখতে-পড়তেও পারত। বাবার হবির ব্যাপারে রজতবাবুকে ও সাহায্য করত।
তা হলে তো মনে হচ্ছে ওকে খুঁজে বের করলেই আমাদের সমস্যার সমাধান হবে, বললেন সাহা।আপনাদের টেলিফোনটা একটু ব্যবহার করতে পারি?
নিশ্চয়ই, বলে সমীরণবাবু সাহাকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কিন্তু মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-টা কেন দেওয়া হল, সেটা তো বুঝতে পারছি না ফেলুবাবু, বললেন লালমোহনাবু। চুরিই যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তা হলে তো সে কাজটা ত্ৰিশটা বড়ি খাইয়ে কেইশ করেই হয়ে যায়। আবার ছোরা কেন?
ফেলুদা বলল, মনে হয় শুধু বড়িতে আততায়ী নিশ্চিন্ত হতে পারেনি। হয়তো যে সময় মূর্তিটা চুরি করতে এসেছিল, সেই সময় মজুমদার একটু নড়াচড়া করেছিলেন। বড়ির অ্যাকশন হতে তো সময় লাগে! এই নড়াচড়া দেখেই ঘাবড়ে গিয়ে ছোরাটা মারা হয়েছে। এবং তারপর মূর্তিটা সরানো হয়েছে।
কিন্তু তা হলে বিষটা কখন লেখা হল?
সেটা অবিশ্যি ছারা মারার আগেই হয়েছে-যখন মজুমদার প্রথম বুঝেছেন যে, তাঁকে কিছু একটা খাইয়ে বেষ্ট্রশ করার চেষ্টা হয়েছে। লেখাটা লিখেই উনি অন্তত সাময়িকভাবে সংজ্ঞা হারান। এ ছাড়া আর কোনও সমাধান আপাতত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
ফেলুদা যে খুশি নয় সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম।
সাহা ইতিমধ্যে ঘরে ফিরে এসেছিলেন; বললেন, আমার কাছে ইট সার্টেনলি মেক্স সেন্স।..যুক্ যে, আমি লোক লাগিয়ে দিয়েছি। ইতিমধ্যে অবিশ্যি আমার অন্য কাজ চালিয়ে যেতে হবে। আমি এ বাড়ির এবং ফিল্মের দলের সকলকে জেরা করতে চাই।
একটা কথা, বললেন লালমোহনবাবু।ফিল্মের দলের মধ্যে সকলের কিন্তু বাড়ির উত্তর দিকের বাথরুম ব্যবহার করার অধিকার ছিল না। সে অধিকার ছিল পরিচালক পুলক ঘোষালের, ক্যামেরাম্যান সুদেব ঘোষ, রায়না, ভার্মা, আর আমার।
তা হলে শুধু তাদেরই জেরা করা হবে, বললেন সাহা।
মানে, আমাকেও? ধরা গলায় প্রশ্ন করলেন লালমোহনবাবু।
তা তো বটেই, বলল ফেলুদা।সুযোগ যাদের ছিল, তাদের মধ্যে আপনি তো একজন বটেই।
সাহা বললেন, এ ছাড়া আছে বাড়ির লোক; অর্থাৎ–ভদ্রলোক সমীরণবাবুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিলেন।
সমীরণবাবু বললেন, অর্থাৎ আমি, রজতবাবু, চাকর বাহাদুর, আর রান্নার লোক জগদীশ।
ভেরি গুড।
০৭. জেরা শেষ
পরদিন সকালে সাড়ে নটায় পুলক ঘোষাল আমাদের হোটেলে এলেন। আপনাদের জেরা শেষ? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল ভদ্রলোককে।
তা শেষ, বললেন পুলক ঘোষাল।কাল রাত সাড়ে নটায় ছাড়া পেয়েছি। কিন্তু কী ঝঞ্জাটে পড়া গেল দেখুন তো! যদিন না তদন্ত শেষ হচ্ছে, তদিন তো ও-বাড়িতে শুটিং বন্ধ। অবিশ্যি সমীরণবাবু বলেছেন যে সব মিটে গেলে ওঁদের বাড়িতে আবার কাজ করতে দেবেন, কিন্তু সেটা কবে তা কে বলতে পারে? কত টাকা লস্ হল আমাদের ভাবতে পারেন?
লালমোহনবাবু চুকচুক করে সহানুভূতি জানালেন।
তবে এটা ঠিক, বললেন পুলকবাবু, একটা প্রোডাকশনে বাধা পড়লে সচরাচর সে ছবি হিট হয়। আর, একটা কথা। আপনি জানবেন লালুদা-আপনার গল্পের মার নেই।
পুলকবাবু চলে যাবার আধা ঘণ্টার মধ্যেই ইনস্পেক্টর যতীশ সাহা এলেন। বললেন, নো পাত্তা অফ লোকনাথ বেয়ারা। আমরা শিলিগুড়িতে পর্যন্ত লোক লাগিয়ে দিয়েছি। তবে আমার মনে হয় ইট্স এ ম্যাটার অফ টাইম। এখন হয়তো কোনও ভুটিয়া বস্তিতে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে; সুনার আর লেটার ধরা পড়তে বাধ্য। আমার দৃঢ় বিশ্বাস লোকটা কলকাতায় যাবার তাল করেছে; সেইখানে ও মূর্তিটা পাচার করবে। আশ্চর্য-সিধে মানুষও লোভে পড়লে কী রকম বেঁকে যায়।
আপনার জেরা তো হয়ে গেছে শুনলাম, বলল ফেলুদা।
তা হয়েছে, বললেন সাহা।এতে একটা জিনিস প্রমাণ হল যে, ফিল্ম শুটিং-এর ব্যাপারে মানুষের কৌতুহলের সীমা নেই। বাড়ির প্রত্যেকটি লোক বেশ কিছুটা করে সময় কাটিয়েছে শুটিং দেখে। মিঃ মজুমদার তাঁর রুটিন ব্রেক করলেন—ভাবতে পারেন? অথচ ওঁর জীবনটা চলত ঘড়ির কাঁটার মতো!
ফেলুদা বলল, সুযোগের ব্যাপারটা কী মনে হল? মোটিভটা এখন থাক।
এখানে অবিশ্যি দুটো ব্যাপার দেখতে হবে, বললেন সাহা।এক, দুধে বড়ি মেশানো, আর দুই, ছারা মেরে মূর্তি চুরি। দেড়টা নাগাত লোকনাথ দুধ রেডি করে মজুমদারকে খবর দিতে গোসূল। সে নিজেই ত্ৰিশটা বড়ি মেশাতে পারে। অথবা সে যখন ছিল না, তখন অন্য লোক কাজটা করতে পারে; রজতবাবু বললেন তখন উনি নিজের ঘরে শুয়ে বই পড়ছিলেন। সমীরণবাবুও বললেন তিনি নিজের ঘরে ছিলেন। এ সবের অবিশ্যি কোনও প্রমাণ নেই। চাকর বাহাদুর আর রান্নার লোক জগদীশ শুটিং দেখছিল। দিস ইজ এ ফ্যাক্ট।
আপনাদের ডাক্তার খুনের টাইম সম্বন্ধে কী বলেন?
বলছেন আড়াইট থেকে সাড়ে চারটার মধ্যে স্ট্যাবিংটা হয়েছে। ছুরিকাঘাতেই যে মৃত্যু হয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই, তা না হলে এত ব্রিডিং হত না।