সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, বলল ফেলুদা। আর আপনাদের সাহায্য ছাড়া আমি এগোতেই পারব না।
সমীরণবাবু এসেছেন ঘরে, তাঁর মুখ ফ্যাকাসে, চুল উসকোখুসকো।
ফেলুদা তাঁর দিকে ফিরে বললেন, ব্যাপারটা তো আপনিই ডিসকভার করেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ, বললেন সমীরুণবাবু। বাবা ঘড়িতে অ্যালাম দিয়ে ঠিক পাঁচটায় উঠে গিয়ে বারান্দায় বসতেন। তার পর লোকনাথ চা এনে দিত। আজ সোয় পাঁচটায় বাবাকে জায়গায় না দেখে ভাবলাম ব্যাপার কী। খট্কা লাগল, তার পর বাবার শোবার ঘরে গেলাম। ঘরে ঢুকেই দেখি এই কাণ্ড।
এই খুন সম্বন্ধে আপনার কিছু বলার আছে? আপনার নিজের কোনও ধারণা হয়েছে এ সম্বন্ধে?
ফেলুদা প্রশ্ন করতে করতে ঘরটা পায়চারি করে দেখছে, কোনও কিছুই তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়াচ্ছে না।
কেবল একটা কথা বলার আছে বললেন সমীরণবাবু।
কী?
ঘরে একটা জিনিস মিসিং।
কী জিনিস?
আমরা সকলেই কৌতুহলী দৃষ্টি দিলাম ভদ্রলোকের দিকে।
অষ্টধাতুর একটা বালগোপাল, বললেন সমীরণবাবু। এটা ছিল আমাদের নিয়নপুরের বাড়ির মন্দিরে। অনেক দিনের সম্পত্তি, এবং অত্যন্ত মূল্যবান জিনিস।
কোথায় থাকত এটা?
ওই তাকের উপর। ভুজালিটার পাশেই।
সমীরণবাবুঘরের একটা সেলফের দিকে ইঙ্গিত করলেন।
যতীশ সাহা বললেন, এমন একটা জিনিস সিন্দুকে না রেখে বাইরে রাখা হত কেন?
তার কারণ বাবা তো রাত্রে ঘুমোতেন না, আর সঙ্গে রিভলবার থাকত, তাই কোনও বিপদ আছে বলে মনে করেননি।
তা হলে তো রবারিই মোটিভই বলে মনে হচ্ছে, বললেন সাহা।জিনিসটার দাম কত হবে?
তা ষাট-পয়ষট্টি হাজার তো হবেই। সোনার অংশ বেশ বেশি ছিল।
ফেলুদা খাটের পাশের টেবিল থেকে একটা পেনসিল তুলে নিয়ে বলল, শিসটা ভাঙা, এবং ভাঙা টুকরোটা পাশেই পড়ে আছে।
আমি দেখলাম পেনসিালের পাশে একটা ছোট্ট প্যাডও রয়েছে।
ফেলুদা নিচু হয়ে প্যাডের উপরের কাগজটা দেখছিল। তারপর বিড়বিড় করে বলল, ওপরের কাগজটা ছিড়েছে বলে মনে হচ্ছে…
এবারে ও আরও নিচু হয়ে টেবিলের চার পাশের মেঝেটাি দেখতে লাগল। তারপর মেঝে থেকে একটা কাগজ তুলে নিয়ে বলল, পেয়েছি।
আমি দূর থেকেই বুঝলাম প্যাডের কাগজের উপর কী যেন একটা লেখা রয়েছে।
কাগজটা নিজে ভাল করে দেখে ফেলুদা সেটা সাহার দিকে এগিয়ে দিল। সাহা কাগজটা হাতে নিয়ে লেখাটা পড়ে চোখ কপালে তুলে বললেন, বিষ?
তই তো লিখছেন ভদ্রলোক, বলল ফেলুদা। আর যে ভাবে ষ-এর পেট কাটা হয়েছে, মনে হয় তার পরেই মৃত্যুটা হয়, এবং শিস ভেঙে পেনসিলটা হাত থেকে পড়ে যায়, আর কাগজটাও প্যাড থেকে আলগা হয়ে মাটিতে পড়ে।
কিন্তু বিষ কথাটা লিখবার অর্থ কী? বললেন সাহা, যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ছুরি দিয়ে মারা হয়েছে?
সেটাই তো ভাবছি, ভূকুটি করে বলল ফেলুদা। তারপর সমীরণবাবুর দিকে ফিরে বলল, মিঃ মজুমদারের ঘুমের ওষুধ কোথায় থাকত, জানেন?
ডাইনিং রুমে একটা বোতলের মধ্যে, বললেন সমীরণবাবু। দোকান থেকে এলেই লোকনাথ টিন-ফয়েল ছিঁড়ে বড়িগুলো বার করে বোতলে রেখে দিত।
সেই বোতলটা একবার আনতে পারেন?
সমীরণবাবুর ফিরে আসতে যেন একটু বেশি সময় লাগল। আর যখন এলেন তখন ভদ্রলোকের মুখ আরও ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
বোতল নেই, ধরা গলায় বললেন ভদ্রলোক।
ফেলুদার ভাব দেখে মনে হল সে যেন এটাই আশা করছিল। বলল, গত পরশু সন্ধ্যায় আমাদের সামনেই ভদ্রলোক একমাসের স্টক কিনলেন ওই ওষুধের। তারপর সাহার দিকে ফিরে বলল, এই বাড়ির খান ত্রিশেক একসঙ্গে একজন মানুষকে খাওয়ালে তার মৃত্যু হতে পারে না?
এটা কী বড়ি?
টফ্রানিল। অ্যান্টি-ডিপ্রেসান্ট পিল্স।
তা নিশ্চয়ই হতে পারে, বললেন সাহা।
এবং তখন সে বড়িকে বিষ বলা যেতে পারে না?
নিশ্চয়ই।
তা হলে বিষ কথাটার একটা মানে পাওয়া যাচ্ছে, যদিও…। ফেলুদার যেন খট্কা লাগছে। একটু ভেবে বলল, যে লোককে খুন করা হচ্ছে সে যদি মরার পূর্বমুহূর্তে কিছু লিখে যায় তা হলে কী ভাবে তাকে মারা হচ্ছে সেটা না লিখে সে যাকে আততায়ী বলে সন্দেহ করছে তার নামটাই লিখে যাবে না কি?
কথাটা আপনি ঠিকই বলেছেন, বললেন সাহা, কিন্তু এক্ষেত্রে ভদ্রলোক সেটা করেননি সেটা স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে।..ভাল কথা, একবার বেয়ারা লোকনাথকে ডাকলে হত না?
ফেলুদা প্রস্তাবটা সমর্থন করে সমীরণবাবুর দিকে চাইল। সমীরুণবাবু ইঙ্গিতটা বুঝে নিয়ে লোকনাথের খোঁজে বেরিয়ে গেলেন।
ফেলুদার চোখ থেকে যে ভ্রূকুটি যাচ্ছে না সেটা আমি লক্ষ করছিলাম। লালমোহনবাবু বললেন, লোকনাথ দেড়টা নাগাত একবার দক্ষিণের বারান্দায় এসেছিল মিঃ মজুমদারকে ডাকতে। কিন্তু মিঃ মজুমদার তৎক্ষণাৎ যাননি।
তার মানে আজকে তাঁর নিয়মের কিছু ব্যতিক্রম হয়েছিল, বলল ফেলুদা।
হ্যাঁ, বললেন লালমোহনবাবু।মনে হচ্ছিল ভদ্রলোক শুটিং-এর ব্যাপারটাতে বেশ ইন্টারেস্ট পাচ্ছিলেন। রায়না। আর ভার্মাকে সুযোগ পেলেই নানা রকম প্রশ্ন করছিলেন।
সমীরুণবাবু ঘরে ফিরলেন। তাঁর মুখ দেখেই বুঝলাম, খবর ভাল না। কিন্তু যা শুনলাম, ততটা তাজ্জব খবর আমি আশা করিনি।
লোকনাথকে পাওয়া যাচ্ছে না, বললেন সমীরুণবাবু।
পাওয়া যাচ্ছে না? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
না, বললেন সমীরণবাবু। সে দেড়টার কিছু পর থেকেই মিসিং। চাকররা দুটো নাগাত খেত।–লোকনাথ খায়ওনি। কোথায় গেছে, কখন গেছে, কেউ বলতে পারছে না।