বাংলায় বললেন কথাটা?
ঠিক আমি যেমন বললাম। প্ৰথম অংশ ইংরিজি, বাকিটা বাংলা।
তার মানে ভদ্রলোক তখনও ঘুমোননি?
না; কারণ কাল যখন লাঞ্চ ব্রেক হয়, তখনও ভদ্রলোককে দক্ষিণের বারান্দায় দেখেছি। উনি শুটিং দেখতে এসেছিলেন। সকালে আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। উনি দেড়টায় বড়িটা খান, তার পর ঘুমোন। আমি যখনকার কথা বলছি, তখন দেড়টা বেজে মিনিট সাতেক হয়ে গেছে।
ভদ্রলোকের কথার উত্তরে অন্য লোকটি কিছু বললেন না?
বলে থাকলেও সেটা এত চাপা গলায় যে, আমি শুনতে পাইনি। আমার আবার তখন তাড়া—লাঞ্চ রেডি—তাই আর অপেক্ষা না করে চলে এলাম। কিন্তু মিঃ মজুমদারই যে কথাটা বলেছেন, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
তার মানে হয় রজত বোস, না হয় নিজের ছেলে সমীরণ মজুমদারকে বলেছেন কথাটা। লালমোহনবাবু হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে বললেন, তবে একটা কথা কিন্তু বলতেই হবে মশাই। এই সব বোম্বাই-অভিনেতাদের বিষয়ে যত কিছু শোনা যায়, আসলে তত কিছু নয়।
এটা কেন বলছেন?
লাঞ্চের পর রায়নার সঙ্গে একটা শট ছিল, সেটা ছেকরার ভুলের জন্য পাঁচবার করে নিতে হল। সামান্য ডায়ালগ, তবু বার বার ভুল করছে।
ও রকম হয়েই থাকে, বলল ফেলুদা, সেরা অভিনেতারও হঠাৎ হঠাৎ নাৰ্ভ ফেল করতে পারে।
সব শেষে জটায়ু বললেন, যেটুকু নার্ভাসনেস ছিল, আজ সম্পূর্ণ কেটে গেছে। আর কোনও ভাবনা নেই।
০৬. বজ্ৰপাতটা হল পরের দিন
বজ্ৰপাতটা হল পরের দিন, তবে আসল ঘটনাটা সরাসরি না বলে আগে দিনটা কীভাবে গেল বলি।
দিনটা মেঘলা, তাই কাঞ্চনজঙ্ঘা রয়েছে আড়ালে। আমি ফেলুদার সঙ্গে সকলে বেরিয়ে একটু কেনাকাটা সেরে, বার্চ হিল রোড দিয়ে খানিকদূর বেড়িয়ে এগারোটা নাগাত রওনা দিলাম নয়নপুর ভিলায়। গতকাল রাত্রেও ফেলুদা লালমোহনবাবুকে তালিম দিয়েছে। এবারে সাড়ে তিনের জায়গায় সবসুদ্ধ পাঁচ লাইন ডায়ালগ। আজ আর চুরুট-সিগারেট ধরানোর ব্যাপার নেই, তাই সেদিক থেকে বাঁচোয়া।
লালমোহনবাবুর সাতটা শট ছিল। সাড়ে নটায় কাজ আরম্ভ হয়েছে। আড়াইটেয় লাঞ্চ ব্রেক হয়েছে। লাঞ্চের আগে চারটে, পরে তিনটে শট হয়ে সাড়ে চারটের সময় লালমোহনবাবু ফ্রি হয়ে গেলেন। পুলক ঘোষাল বলল, জিপের ব্যবস্থা আছে লালুদা, আপনি এনি টাইম যেতে চাইলে যেতে পারেন।
লালমোহনবাবু বললেন, আজি যখন তাড়াতাড়ি শেষ হল, তখন ভাবছি হেঁটেই বাড়ি ফিরব; গাড়ির দরকার নেই।
জাস্ট অ্যাজ ইউ লাইক, বলল পুলক ঘোষাল।
পুলক ঘোষাল চলে গেলে পর লালমোহনবাবু বললেন, এদের চা-টা বেশ ভাল; এক্ষুনি চা দেবে, সেটা খেয়ে বেরিয়ে পড়ব।
দেড় মাইলের উপর রাস্তা, তাই চা খেয়ে পাঁচটা নাগাত বেরিয়ে হোটেল পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে পাঁচটা হয়ে গেল।
ঘরে ঢুকেই দেখি ফেলুদা গায়ে জ্যাকেট চাপাচ্ছে।
বেরোচ্ছ নাকি? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
ফেলুদা আমাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, তোরা ছিলি না। ওখানে? তোরা শুনিসনি?
আমরা তো আধা ঘণ্টা হল বেরিয়েছি, তখন পর্যন্ত তো কিছু শুনিনি। কী ব্যাপার?
মিঃ মজুমদার খুন হয়েছেন।
অ্যাঁ।
আমরা দুজনেই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম।
ভদ্রলোক সাড়ে বারোটা নাগাত আমায় ফোন করেছিলেন। বললেন আমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে, সেটা সন্ধ্যায় আমার এখানে এসে বলবেন। আর তার পর এই ব্যাপার।
তুমি খবর পেলে কী করে?
ওঁর ছেলে ফোন করেছিলেন এই পাঁচ মিনিট আগে। পুলিশে খবর দিয়েছেন, কিন্তু আমাকেও যেতে বললেন। পাঁচটার পরেও ভদ্রলোকের ঘুম ভাঙছে না দেখে সমীরণবাবু ওঁর ঘরে ঢোকেন; বাবাকে কী যেন একটা বলার ছিল। দরজাটা কেবল ভেজানো ছিল; মিঃ মজুমদার ছিটিকিনি লাগাতেন না। কখনও। ঢুকে দেখেন রক্তাক্ত কাণ্ড! বুকে ছারা মেরেছে ঘুমন্ত অবস্থায়। ওঁর বাড়ির ডাক্তার এসে বলে গেছেন ছুরির আঘাতেই মৃত্যু হয়েছে। শুটিং অবশ্যই বন্ধ হয়ে গেছে, এবং স্বভাবতই কিছু দিন বন্ধ রাখতে হবে। কারণ পুলিশ তদন্ত করবে। যাই হাক-আমি তো চললাম! তোরা কি থাকিবি, না আমার সঙ্গে যাবি?
থাকব কী! বললেন লালমোহনবাবু। এর পরে কি আর থাকা যায়? চলুন বেরিয়ে পড়ি।
আমরা তিনজন যখন নয়নপুর ভিলা পীছলাম, তখন সোয়া ছটা। চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেছে, আকাশে মেঘ, টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। শুটিং-এর দলের সকলেই রয়েছে। পুলক ঘোষাল কাছেই ছিলেন, আমাদের দেখে এগিয়ে এসে বললেন, কী বিশ্ৰী ব্যাপার বলুন তো! ভারী মাই ডিয়ার লোক ছিলেন মিঃ মজুমদার। এক কথায় কাজ করার অনুমতি দিয়ে দিয়েছিলেন।
বাড়ির বাইরে পুলিশের জিপ দাঁড়িয়ে আছে সেটা আগেই লক্ষ করেছি।
আমরা বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। সামনের বারান্দায় একজন ইনস্পেক্টর দাঁড়িয়ে আছেন। বছর চল্লিশেক বয়স, ফেলুদার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, আপনার নাম অনেক শুনেছি। আমি ইনস্পেক্টর যতীশ সাহা।
করমর্দন শেষ হবার পর ফেলুদা বলল, কী ব্যাপার? কী বুঝলেন?
ঘুমের মধ্যেই খুনটা হয়েছে, যত দূর মনে হয়।
কী দিয়ে মেরেছে?
একটা ভুজালি। সেটা বুকেই ঢোকানো রয়েছে। ওটা নাকি মিঃ মজুমদারের ঘরেই থাকত।
আপনাদের ডাক্তার এসেছেন কি?
এই এলেন বলে। আসুন না ভিতরে।
মিঃ মজুমদারের শোবার ঘরটা বেশ বড়। আমি লালমোহনবাবু দরজার মুখেই দাঁড়িয়ে রইলাম, ফেলুদা ভিতরে গেল। মৃতদেহ সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে।
একটা কথা আপনাকে বলে দিই, ফেলুদাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে বললেন যতীশ সাহা, আমরা তো যথারীতি আমাদের ইনভেসটিগেশন চালিয়ে যাব, তবে আপনি যখন এখানে রয়েছেন, তখন আপনিও আপনার নিজের তরফ থেকে যা করতে চান, করতে পারেন। কেবল আমাদের যা কিছু ফাইন্ডিংস পরস্পরকে জানালে বোধহয় কাজের দিক দিয়ে সুবিধা হবে।