হ্যাঁ, লোকটা সব সময় যেন কিছু একটা ভাবছে। সেটা হয়তো বোঝা যাবে ওঁর সম্বন্ধে গুজবটা কী সেটা জানলে।
আমরা প্রায় দেড় ঘণ্টা ঘোরার পর হোটেলে ফিরলাম। ফেলুদা বলল, তুই আজ মনের আনন্দে শুটিং দেখিস; আমার কথা চিন্তা করিস না। আমি ভাবছি, একবার অবজারভেটরি হিলের মাথায় গুম্ফাটা দেখে আসব।
আমি ঠিক সময়ে সাড়ে এগারোটায় বেরিয়ে কুড়ি-পঁচিশ মিনিটে নয়নপুর ভিলায় পৌঁছে গেলাম। ফন্ট ফন্ট শব্দ শুনে বুঝলাম যে জেনারেটর চালু হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা যে কোথায় রাখা হয়েছে, তা বুঝতে পারলাম না। আমাকে দেখে ওদের দলের একজন এগিয়ে এসে ভিতরে ডেকে নিয়ে গেল। এ দিকটা বাড়ির দক্ষিণ দিক, এ দিকে কাল আসিনি। একটা ঘরের মধ্যে কাজ হচ্ছে, সেখানে জোরালো স্টুডিয়ার আলো জ্বলছে। জানালা বন্ধ করে বাইরে থেকে দিনের আলো আসার পথ বন্ধ করে দিয়েছে। বুঝলাম দৃশ্যটা বোধহয় রাত্রের দৃশ্য, যদিও তোলা হচ্ছে দিনের বেলা।
কিন্তু আমাদের জটায়ু কোথায়?
ও মা–ওই তো ভদ্রলোক! কিন্তু প্রথম দেখে একেবারেই চিনতে পারিনি।–দাড়ি আর পরচুলায় চেহারা এত বদলে গেছে। দিব্যি ভিলেন-ভিলেন লাগছে ভদ্রলোককে। আমায় দেখতে পেয়ে চেয়ার থেকে উঠে এগিয়ে এসে বেশ ভারিব্ধি চালে জিজ্ঞেস করলেন, কী মনে হচ্ছে? চলবে?
আমি ভদ্রলোকের চেহারার তারিফ করে বললাম, আপনার কথাগুলো মনে আছে তো?
আলবৎ! উীষণ কনফিডেন্সের সঙ্গে বললেন ভদ্ৰলোক।
অন্য একটা সোফায় বসে মহাদেব ভার্মা তাঁর গোঁফে চাড়া দিচ্ছিলেন। এবার পুলক ঘোষালের গলা পেলাম।
লালুদা।
লালমোহনবাবু তাড়াতাড়ি গিয়ে তাঁর চেয়ারে বসলেন। আমি একটা সুবিধের জায়গা বেছে নিয়ে সেখান থেকে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম।
পুলক ঘোষাল এবার লালমোহনবাবুর সামনে দাঁড়িয়ে হাত-পা নেড়ে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন।
লালুদা, আপনি প্রথমে বুক পকেট থেকে একটা চুরুট বার করে মুখে পুরবেন; সেই সঙ্গে মহাদেবও একটা সিগারেট মুখে পুরবে। তারপর আপনি পকেট থেকে, দেশলাই বার করে মহাদেবের সিগারেটটা ধরিয়ে দেবেন, তারপর নিজের চুরুটটা ধরাবেন। তার পরে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসবেন। তখন আমি ইয়েস বলাব। তাতে আপনি চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে আপনার প্রথম কথাটা বলবেন। এর পরেই শটু শেষ। এই শর্টুটা কিন্তু প্রধানত আপনারই শটি! ক্যামেরা আপনারই মুখ দেখছে, আর মহাদেবের দেখছে পিঠ। বুঝেছেন?
ইয়েস, বললেন লালমোহনবাবু। তবে একটা কথা।
বলুন।
এ দেশলাইট জ্বলবে তো?
হ্যাঁ হ্যাঁ। একেবারে টাট্কা। আজই সকলে কেনা।
ভেরি গুড।
মিনিটখানেক আরও আমড়াগাছির পর শট আরম্ভ হল। ক্যামেরা আর সাউন্ড চালু হল, আর পুলকবাবু বলে উঠলেন, অ্যাকশন!
লালমোহনবাবু মুখে চুরুট পুরলেন ঠিকই, কিন্তু দেশলাইটা ধরাতে গিয়ে বারুদের দিকটা হাতে ধরে উলটা দিকটা ঘষতে লাগলেন দেশলাইয়ের গায়ে। খচ্ খচ্ খচ্ খচ্–দেশলাই আর জ্বলে না, এ দিকে ক্যামেরা চলেছে ঘড়ঘড় শব্দ করে।
কাট, কাট। চেঁচিয়ে উঠলেন পুলক ঘোষাল। লালুদা, আপনার বোধহয়—
সরি ভাই, ভেরি সরি। এবার আর ভুল হবে না।
দ্বিতীয়বার অবিশ্যি চুরুট আর সিগারেট ঠিকই জ্বলল, কিন্তু চুরুটে টানটা একটু বেশি মাত্রায় হওয়ায় লালমোহনবাবুর বিষম লেগে শটুটা নষ্ট হয়ে গেল, আর পুলক ঘোষালকে আবার চেঁচিয়ে বলতে হল, কাট, কাট!
তিনবারের বার আর কোনও ভুল হল না। ও কে! বলে চেঁচিয়ে উঠলেন পুলক ঘোষাল, আর সকলে লালমোহনবাবুকে তারিফ করে হাততালি দিয়ে উঠল।
আশ্চর্য এই যে, আরও পাঁচ ঘণ্টা লালমোহনবাবুকে নিয়ে কাজ হল আর তার মধ্যে ভদ্রলোক একটাও ভুল করলেন না। এর মধ্যে অবিশ্যি ভদ্রলোককে দুবার বাথরুমে যেতে হয়েছিল; সেটা শীতের জন্যও হতে পারে আবার নার্ভাসনেসের জন্যও হতে পারে। মোট কথা, পুলক ঘোষাল স্যাটিসফাইড।
কাল আবার সেম টাইমে লো যাবে কিন্তু, বললেন পুলকবাবু।
লোক যাবার কোনও দরকার ছিল না ভাই, বললেন লালমোহনবাবু। আমি এমনিই চলে আসতে পারতাম।
না না, তা কি হয়? বললেন পুলকবাবু। আমরা সকলের জন্যই লোক পাঠাই। ওটা আমাদের একটা নিয়ম।
লালমোহনবাবুর মেক-আপ তুলতে লাগল দশ মিনিট, তারপর প্রোডাকশনের একটা জিপে করে আমরা আমাদের হোটেলে ফিরে এলাম।
নিজের ঘরে না গিয়ে আমাদের ডাবল রুমে এসে লালমোহনবাবু বিছানায় চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়লেন। আমি ফেলুদাকে বলে দিলাম। লালমোহনবাবুর কাজ খুব ভাল হয়েছে আর সকলে খুব তারিফ করেছে।
বাঃ, তা হলে আর কী, বলল ফেলুদা, তা হলে তো বাজিমাৎ। একটা নতুন দিক খুলে গেল। এবার আর শুধু রহস্য-রোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক নয়, চলচ্চিত্রাভিনেতাও বটে।
লালমোহনবাবু এতক্ষণ চোখ বুজে পড়ে ছিলেন, হঠাৎ চোখ খুলে উঠে বসে ফেলুদার দিকে চেয়ে বললেন, দেখছেন, আরেকটু হলে ভুলেই যাচ্ছিলাম। আপনাকে যে একটা অত্যন্ত জরুরি কথা বলার আছে।
কী ব্যাপার?
শুনুন মন দিয়ে। আজ দেড়টায় লাঞ্চ ব্রেক হয়েছে। আমি সেই ফাঁকে টুক করে একবার স্মল ওয়র্ক সািরতে গিয়েছিলাম বাথরুমে। বাড়ির দক্ষিণে আমাদের কাজ হচ্ছে; সে দিকে বাথরুম আছে, কিন্তু তার ভেতর এরা শুটিং-এর যাবতীয় মালপত্তর রেখেছে; তাই আমাকে যেতে হল উত্তর দিকে—অর্থাৎ যে দিকে মিঃ মজুমদার থাকেন। প্রোডাকশনের একজন ছোকরাই আমাকে বাথরুমটা দেখিয়ে দিল। আমি গেলুম। এটা একটা আলাদা বাথরুম, বেডরুমের সঙ্গে অ্যাটাচড় নয়। আমি কাজ সেরে হাত ধুয়ে চাখে-মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে, বাইরে এসেই কাছের কোনও একটা ঘর থেকে শুনি মিঃ মজুমদারের গলা। ভদ্রলোক কাকে যেন কড়া গলায় শাসনের সুরে বলছেন, ইউ আর এ লায়ার; তোমার একটা কথাও আমি বিশ্বাস করি না। যদিও গলার স্বর চাপা, কিন্তু তাতে যে ঘোর বিরক্তি প্ৰকাশ পাচ্ছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।