ইয়ে, রেনেসাঁস বলতে বোঝাচ্ছেটা কী?
পঞ্চদশ আর ষোড়শ শতাব্দী। এই দেড়শো-দুশো বছর হল ইটালির পুনর্জন্মের যুগ। রেনেসাঁস হল পুনর্জন্ম, পুনর্জাগরণ।
কেন পুনঃ বলছে কেন? হোয়াই এগেইন?
কারণ প্রাচীন গ্রিক ও রোম্যান সভ্যতার আদর্শে ফিরে যাওয়ার একটা ব্যাপার ছিল এই যুগে-যে আদর্শ মধ্যযুগে হারিয়ে গিয়েছিল। তাই রেনেসাঁস। ইটালিতে শুরু হলেও রেনেসাঁসের প্রভাব ক্ৰমে ছড়িয়ে পড়েছিল সমস্ত ইউরোপে। বহু প্ৰতিভা জন্মেছে এই সময়টাতে। শিল্পে, সাহিত্যে, সংগীতে, বিজ্ঞানে, রাজনীতিতে। ছাপাখানার উদ্ভব এই সময়; তার মানে শিক্ষার প্রসার এই সময়। কোপনিকাস, গ্যালিলিও, শেক্সপিয়র, দাভিঞ্চি, রাফেল, মাইকেল এঞ্জেলো—সব এই দেড়শো-দুশো বছরের মধ্যে।
তা আপনার কি ধারণা বৈকুণ্ঠপুরের খীশুও আঁকা হয়েছে এই রেনেসাঁসের যুগে?
তার কাছাকাছি তো বটেই। আগে নয় নিশ্চয়ই, বরং সামান্য পরে হতে পারে। মধ্যযুগের পেন্টিং-এ মানুষ জন্তু গাছপালা সব কিছুর মধ্যে একটা কেঠো-কেঠো, আড়ষ্ট, অস্বাভাবিক ভাব দেখতে পাবেন। রেনেসাঁসে সেটা আরও অনেক জীবন্ত, স্বাভাবিক হয়ে ऊ6।?
এই যে সব নাম দেখছি এ বইয়ে-গায়োট্টো–
গায়োট্টো লিখেছে নাকি?
তই তো দেখছি। গায়োট্টো, বটিসেল্লি, মানটেগনা…
আপনি ও বইটা রাখুন। আমি আর্টিস্টের নামের একটা তালিকা করে দেব-আপনি চান তো সে নামগুলো মুখস্থ করে রাখবেন। গায়োষ্ট্রো নয়। ইংরিজি উচ্চারণে জিয়োটা, ইটালিয়ানে জ্যোত্তো। জ্যোত্তো, বত্তিচেল্লী, মানতেন্যা…
এরা সব বলছেন জাঁদরেল আকিয়ে ছিলেন?
নিশ্চয়ই! শুধু এঁরা কেন? এ রকম অন্তত ত্ৰিশটা নাম পাবেন শুধু ইটালিতেই।
আর এই ত্ৰিশ জনের মধ্যে একজনের আঁকা ছবি রয়েছে বৈকুণ্ঠপুরে? বোঝো!
রাত্রে খাওয়া-দাওয়া সেরে জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেলুদা নিয়োগীদের বংশলতিকা খাটে বিছিয়ে সেটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল। সেই সঙ্গে অবিশ্যি চন্দ্ৰশেখরের জীবন সংক্রান্ত তারিখগুলোও ছিল। সে কার দাদু, কে কার কাকা, কে কার ভাই, এগুলো আমার একটু গুলিয়ে যাচ্ছিল। এবার সেটা পরিষ্কার হয়ে গেল।
দুটো জিনিসের চেহারা এই রকম—
বংশলতিকা
১। অনন্তনাথ (১৮৬২-১৯৪১)
- সূর্যশেখর (১৮৮৮-১৯৪৮)
- সৌম্যশেখর (১৯১৩-)
- নবকুমার (১৯৪১-)
- চন্দ্ৰশেখর (১৮৯০-?)
- রুদ্রশেখর (১৯২০–)
- নন্দকুমার (১৯৪৪)?
- রুদ্রশেখর (১৯২০–)
- সৌম্যশেখর (১৯১৩-)
২। চন্দ্ৰশেখর নিয়োগী
১৮৯০ –জন্ম (বৈকুণ্ঠপুর)
১৯১২ –প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি.এ. পাশ
১৯১৪ –রোমযাত্ৰা। অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের ছাত্র
১৯১৭ – কার্লা ক্যাসিনিকে বিবাহ
১৯২০ — পুত্র রুদ্রশেখরের জন্ম
১৯৩৭ –কার্লার মৃত্যু
১৯৩৮ –স্বদেশে প্রত্যাবর্তন
১৯৫৫ –গৃহত্যাগ
০৬. প্লেনে নাগপুরে
প্লেনে নাগপুরে সাড়ে আটটার সময় পৌঁছে, সেখান থেকে দশটা পঞ্চাশের প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে ছিন্দওয়ারা পৌঁছতে প্ৰায় ছটা বেজে গেল। স্টেশনে শেভরোলে গাড়ি নিয়ে হাজির ছিলেন ভূদেব সিং-এর লোক। হাসিখুশি হৃষ্টপুষ্ট মাঝবয়সী এই ভদ্রলোকটির নাম মি. নাগপাল; চারজন গাড়িতে রওনা দিয়ে পৌনে সাতটার মধ্যে পৌঁছে গোলাম ভগওয়ানগড়ের রাজবাড়ি।
নাগপাল বললেন, আপনাদের জন্য ঘর ঠিক করা আছে, আপনারী হাত-মুখ ধুয়ে নিন, সাড়ে সাতটার সময় রাজা আপনাদের মিট করবেন। আমি এসে আপনাদের নিয়ে যাব।
ঘরের চেহারা দেখেই বুঝলাম যে আজ রাতটা আমাদের এইখানেই থাকার জন্য ব্যবস্থা হয়েছে। বিছানা, বালিশ, লেপ, মশারি, বাথরুমে তোয়ালে সাবান—সবই রয়েছে। যে কোনও ফাইভ-স্টার হোটেলের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। লালমোহনবাবু বললেন, এখানকার বাথরুমে নাকি তাঁর গড়পারের বাড়ির পাঁচটা বেডরুম ঢুকে যায়। নেহাত টাইম নেই, নইলে টবে গরম জল ভরে শুয়ে থাকতুম আধা ঘণ্টা।
কাঁটায় কটায় সাড়ে সাতটার সময় মিঃ নাগপাল আমাদের রাজার সামনে নিয়ে গিয়ে হাজির করলেন। শ্বেতপাথরের মেঝোওয়ালা বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে আছেন ভুদেব সিং। চেহারা যাকে বলে সীম্যাকাস্তি। বয়স সাতত্তর, কিন্তু মোটেও থুত্থুড়ে নন।
আমরা নিজেদের পরিচয় দিয়ে রাজার সামনে তিনটে বেতের চেয়ারে বসলাম। হাসনাহানা ফুলের গন্ধে বুঝতে পারছি বারান্দার পরেই বাগান, কিন্তু অন্ধকারে গাছপালা বোঝা যাচ্ছে না।
কথাবার্তা ইংরেজিতেই হল, তবে আমি বেশির ভাগটা বাংলা করেই লিখছি। জটায়ুত বলেছিলেন, পার্টিসিপেট করবেন। কতদূর করেছিলেন সেটা যাতে ভাল বোঝা যায়। তাই নাটকের মতো করে লিখছি।
ভূদেব–আমার লেখাটা কেমন লাগল?
ফেলুদা–খুবই ইন্টারেস্টিং। ওটা না পড়লে এরকম একজন শিল্পীর বিষয় কিছুই জানতে পারতাম না।
ভূদেব–আসলে আমরা নিজের দেশের লোকদের কদর করতে জানি না। বিদেশ হলে এ রকম কখনওই হত না। তাই ভাবলাম—আমার তো বয়স হয়েছে, সেভেনটি-সেভেন–মরে যাবার আগে এই একটা কাজ করে যাব। চন্দ্ৰশেখরের বিষয় জানিয়ে দেব দেশের লোককে। আমার ছেলেকে পাঠিয়ে দিলাম। বৈকুণ্ঠপুর। চন্দ্রর সেলফপোট্রেট আমার কাছে ছিল না। সে আমাকে ছবি তুলে এনে দিল।
ফেলুদা–আপনার সঙ্গে চন্দ্ৰশেখরের আলাপ হয় কবে?
ভূদেব—দাঁড়ান, এই খাতাটায় সব লেখা আছে।..হ্যাঁ, ৫ই নভেম্বর ১৯৪২ সে আমার পোট্রেট আঁকতে আসে এখানে। তার কথা আমি শুনি ভূপালের রাজার কাছ থেকে। রাজার পোট্রেট চন্দ্র করেছিল। আমি দেখেছিলাম। আমার খুব ভাল লেগেছিল। চন্দ্র হ্যাঁড ওয়ান্ডারফুল স্কিল।