নবকুমারবাবু অবিশ্যি তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। বললেন বাড়তি শোবার ঘর কম করে দশখানা আছে। এ বাড়িতে। খাট বালিশ তোশক চাদর মশারি সবই আছে; কাজেই রাত্তিরে থাকার ব্যবস্থা করতে কোনওই হাঙ্গামা নেই। পরার জন্য লুঙ্গি দিয়ে দেবেন। উনি, এমনকী গায়ের আলোয়ান, ধোপে কাচা পাঞ্জাবি, সবই আছে। -আমাকে এখানে মাঝে মাঝে আসতে হয় বলে কয়েক সেট কাপড় রাখাই থাকে। আপনারা কোনও চিন্তা করবেন না।
উত্তরের দিকে পাশাপাশি দুটো পোল্লায় ঘরে আমাদের বন্দাবস্ত হল। লালমোহনবাবু একা একটি জাঁদরেল খাট পেয়েছেন, বললেন, এক’দিন-কা সুলতানের গপ্লের কথা মনে পড়ছে মশাই।
তা খুব ভুল বলেননি। দুপুরে শ্বেত পাথরের থালাবাটি গোলাসে খাবার সময় আমারও সে কথা মনে হয়েছিল। স্নাত্তিরে দেখি সেই সব জিনিসই রুপোর হয়ে গেছে।
আপনার দাদুর স্টুডিয়োটা কিন্তু দেখা হল না, খেতে খেতে বলল ফেলুদা।
সেটা কাল সকালে দেখাব, বললেন নবকুমারব্বাবু।আপনারা যে দুটো ঘরে শুচ্ছেন, ওটা ঠিক তারই উপরে।
যখন শোবার বন্দোবস্ত করছি, তখন বৃষ্টিটা ধরে গেল। জানালায় দাঁড়িয়ে দেখলাম ধ্রুবতারা দেখা যাচ্ছে। চারিদিকে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। রাজবাড়ির পিছনে বাগান, সামনে মাঠ। আমাদের ঘর থেকে বাগানটাই দেখা যাচ্ছে, তার গাছে গাছে জোনাকি জ্বলছে। অন্য কোনও বাড়ির শব্দ এখানে পৌঁছায় না, যদিও পুবে বাজারের দিক থেকে ট্রানজিস্টারের গানের একটা ক্ষীণ শব্দ পাচ্ছি।
সাড়ে দশটা নগাত লালমোহনবাবু গুডনাইট করে তাঁর নিজের ঘরে চলে গেলেন। দুই ঘরের মাঝখানে একটা দরজা আছে। ভদ্রলোক বললেন সেটা বেশ কনভিনিয়েন্ট।
এই দরজা দিয়েই ভদ্রলোক মাঝরাত্তিরে ঢুকে এসে চাপা গলায় ডাক দিয়ে ফেলুদার ঘুম ভাঙলেন। সঙ্গে সঙ্গে অবিশ্যি আমারও ঘুম ভেঙে গেল।
কী ব্যাপার মশাই? এত রাত্তিরে?
শ্ শ্ শ্ শ্! কান পেতে শুনুন।
কোন পাতলাম। আর শুনলাম।
খচ্ খচ্ খচ্ খচু…
মাথার উপর থেকে শব্দটা আসছে। একবার একটা খুঁট শব্দও পেলাম! কেউ হাঁটাচলা করছে।
মিনিট তিনেক পরে শব্দ থেমে গেল।
উপরেই সানড্রো নিয়োগীর স্টুডিয়ো।
ফেলুদা ফিসফিস করে বলল, তোরা থাক, আমি একটু ঘুরে আসছি।
ফেলুদা খালি পায়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।
লালমোহনবাবু আর আমি আমাদের খাটে বসে রইলাম। প্রচণ্ড সাসপেন্স, ফেলুদা না-আসা পর্যন্ত হৃৎপিণ্ডটা ঠিক আলজিভের পিছনে আটকে রইল। প্রাসাদের কোথায় যেন ঘড়িতে ঢং ঢেং করে দুটো বাজল। তারপর আরও দুটো ঘড়িতে।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আবার ঠিক তেমনি নিঃশব্দে এসে ঘরে ঢুকল ফেলুদা।
দেখলেন কাউকে? চাপা গলায় ঘড়ঘড়ে গলায় লালমোহনবাবুর প্রশ্ন।
ইয়েস।
কাকে?
।সিঁড়ি দিয়ে এক তলায় নেমে গেল।
কে?
সাংবাদিক রবীন চৌধুরী।
০৪. রাত্তিরের ঘটনাটা
রাত্তিরের ঘটনাটা আর নবকুমারবাবুকে বলল না ফেলুদা। চায়ের টেবিলে শুধু জিজ্ঞেস করল, স্টুডিয়োটা চাবি দেওয়া থাকে না?
এমনিতে সবসময়ই থাকে, বললেন নবকুমারবাবু, তবে ইদানীং রবীনবাবু প্রায়ই গিয়ে কাজ করেন। রুদ্রশেখরবাবুও যান, তাই ওটা খোলাই থাকে। চাবি থাকে বাবার কাছে।
চা খাওয়ার পর আমরা চন্দ্ৰশেখরের স্টুডিয়োটা দেখতে গেলাম।
তিনতলায় ছাত। তারই একপাশে উত্তর দিকটায় স্টুডিয়ো। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ডান দিকে ঘুরে স্টুডিয়োতে ঢোকার দরজা।
পুরোটাই কাচ। বেশ বড় ঘরের চারদিকে ছড়ানো রয়েছে ভাই করা ছবি, নানান সাইজের কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো সাদা ক্যানভাস, দুটো বেশ বড় টেবিলের উপর রং তুলি প্যালেট ইত্যাদি নানারকম ছবি আকার সরঞ্জাম, জানালার পাশে দাঁড় করানো একটা ইজেল। সব দেখেটেখে মনে হয় আর্টিস্ট যেন কিছুক্ষণের জন্য স্টুডিয়া ছেড়ে বেরিয়েছেন, আবার এক্ষুনি ফিরে এসে কাজ শুরু করবেন।
জিনিসপত্তর সবই বিলিতি, চারিদিক দেখে ফেলুদা মন্তব্য করল।এমনকী লিনসীড অয়েলের শিশিটা পর্যন্ত। রংগুলো তো দেখে মনে হয় এখনও ব্যবহার করা চলে।
ফেলুদা দু-একটা টিউব তুলে টিপে টিপে পরীক্ষা করে দেখল।
হুঁ, ভাল কন্ডিশনে রয়েছে জিনিসগুলো। রুদ্রশেখর এগুলো বিক্রি করেও ভাল টাকা পেতে পারেন। আজকালকার যে কোনও আর্টিস্ট এসব জিনিস পেলে লুফে নেবে।
ঘরের দক্ষিণ দিকের বড় দেয়ালে আট-দশটা ছবি টাঙানো রয়েছে। তার একটার দিকে নবকুমারবাবু আঙুল দেখালেন।
ওটা দাদুর নিজের আঁকা নিজের ছবি।
জানি। চন্দ্ৰশেখর নিজেকে এঁকেছেন বিলিতি পোশাকে। চমৎকার শার্প, সুপুরুষ চেহারা। কাঁধ অবধি ঢেউখেলানো কুচকুচে কালো চুল, দাড়ি আর গোঁফও খুব হিসেব করে আঁচড়ানো বলে মনে হয়।
এই ছবিটাই ওই প্ৰবন্ধের সঙ্গে বেরিয়েছে বলল ফেলুদা।
তা হবে, বললেন নবকুমারবাবু, বাবার কাছে শুনেছিলাম ভূদেব সিং-এর এক ছেলে এখানে এসেছিল এক’দিনের জন্য। বাপের আর্টিকলের জন্য বেশ কিছু ছবি তুলে নিয়ে যায়।
ভদ্রলোকের রং তো তেমন ফরসা ছিল বলে মনে হচ্ছে না।
না, বললেন নবকুমারবাবু। উনি আমার প্রপিতামহ অনন্তনাথের রং পেয়েছিলেন। মাঝারি।
সেই বিখ্যাত ছবিটা কোথায়? এবার ফেলুদা প্রশ্ন করল।
এদিকে আসুন, দেখাচ্ছি।
নবকুমারবাবু আমাদের নিয়ে গেলেন দক্ষিণের দেয়ালের একেবারে কোণের দিকে।
গিল্টিকরা ফ্রেমে বাঁধানো রয়েছে যীশুখ্রিস্টের ছবিটা।
মাথায় কাঁটার মুকুট, চোখে উদাস চাহনি, ডান হাতটা বুকের উপর আলতো করে রাখা। মাথার পিছনে একটা জ্যোতি, তারও পিছনে গাছপালা-পাহাড়-নদী-বিদ্যুৎ-ভরা মেঘ মিলিয়ে একটা নাটকীয় প্রাকৃতিক দৃশ্য।