ভদ্রলোকের ভুরু কুঁচকে গেল।
কুকুর বলে তোরা ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছিস না, এটা আমার মোটে ভাল লাগছে। না। একটা অবোলা জীবকে যে-লোকে এভাবে হত্যা করে তার কি শাস্তি হওয়া উচিত নয়? শুধু কুকুরুকে মেরেছে তা নয়, আমার চাকরকে শাসিয়েছে। তাকে মোটা ঘুষ দিয়েছে। নইলে সে পালাত না। ব্যাপারটা অনেক গণ্ডগোল। আমার তো মনে হয় যে-কোনও ডিটেকটিভের পক্ষে এটা একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। মিস্টার মিত্তির কী মনে করেন জানি না।
আমি আপনার সঙ্গে একমত, বলল ফেলুদা!
যাক! আমি শুনে খুশি হলুম। এবং সে লোককে যদি ধরতে পারেন তো আরও খুশি হব। ভাল কথা–সৌম্যশেখরবাবু ছেলের দিকে ফিরলেন—তোর সঙ্গে রবীনবাবুর দেখা হয়েছে?
রবীনবাবু? নবকুমারবাবু বেশ অবাক। তিনি আবার কে?
একটি জানালিস্ট ভদ্রলোক। বয়স বেশি না। আমায় লিখেছিল আসবে বলে। চন্দ্ৰশেখরের জীবনী লিখবে। একটা ফেলোশিপ না গ্রন্ট কী জানি পেয়েছে। সে দু দিন হল এসে রয়েছে। অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছে। ইটালিও যাবে বলে বলছে। বেশ চৌকস ছেলে; আমার সঙ্গে কথা বলে সকলে ঘণ্টাখানেক ধরে। টেপ করে নেয়।
তিনি কোথায় এখন?
বোধহয় তার ঘরেই আছে। এক তলায় উত্তরের বেডরুমটীয় রয়েছে। আরও দিন দশোক থাকবে। রাতদিন কাজ করে।
সামলানোর আর কী আছে; রোম থেকে আসা খুড়তুতো ভাইটিকে তো সারাদিন প্ৰায় চাখেই দেখি না। আর যখন দেখিও, দুচারটের বেশি কথা হয় না। এমন মুখচোরা লোক দুটি দেখিনি।
যখন কথা বলেন কী ভাষায় বলেন? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
ইংরিজি বাংলা মেশানো। বললে চন্দ্ৰশেখর নাকি ওর সঙ্গে বাংলাই বলত। তবে সেও তো আজ প্ৰায় চল্লিশ বছর হয়ে গেছে। চন্দ্ৰশেখর যখন দেশে ফেরে তখন ছেলের বয়স আঠারো-উনিশ। বাপের সঙ্গে বোধহয় বিশেষ বনত না। পাছে কিছু জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করি তাই বোধহয় কথা বলাটা অ্যাভয়োড় করে। ভেবে দেখুন-আমার নিজের খুড়তুতো ভাই, তাকে পাসপোর্ট দেখিয়ে বোঝাতে হল। সে কে!
ইন্ডিয়ান পাসপোর্ট কি? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
তই তো দেখলাম।
নবকুমার বললে, তুমি ভাল করে দেখেছিলে তো?
ভাল করে দেখার দরকার হয় না। সে যে নিয়োগী পরিবারের ছেলে সে আর বলে দিতে হয় না।
উনি সম্পত্তির ব্যাপারেই এসেছেন তো? জিজ্ঞেস কবল ফেলুদা।
হ্যাঁ; এবং পেয়েও যাবে। সে নিজে তার বাবার কোনও খবরই জানত না। তাই রোম থেকে চিঠি লিখেছিল আমায়। আমিই তাকে জানাই যে দশ বছর হল তার বাপের কোনও খোঁজ নেই। তার পরেই সে এসে উপস্থিত হয়।
ফেলুদা বলল, চন্দ্ৰশেখরের সংগ্রহে যে বিখ্যাত পেন্টিংটা আছে সেটা সম্বন্ধে উনি কিছু জানেন? কিছু বলেছেন?
না। ইনি নাকি ইঞ্জিনিয়ারিং-এর লোক। আর্টে কোনও ইন্টারেস্ট নেই!..তবে ছবিটার খোঁজ করতে লোক এসেছিল।
কে? জিজ্ঞেস করলেন নবকুমারবাবু।
সোমানি না। কী যেন নাম। বঙ্কিমের কাছে তার নাম ঠিকানা আছে। বললে এক সাহেব কালেক্টর নাকি ইন্টারেস্টেড। এক লাখ টাকা অফার করলে। প্রথমে পঁচিশ হাজার দেবে, তারপর সাহেব দেখে জেনুইন বললে বাকি টাকা; দিন পনেরো আগের ঘটনা। তখনও রুদ্রশেখর আসেনি, তবে আসবে বলে লিখেছে। সোমানিকে বললাম এ হল আর্টিস্টের ছেলের প্রপার্টি। সে ছেলে আসছে। যদি বিক্রি করে তো সেই করবে! আমার কোনও অধিকার নেই।
সে লোক কি আর এসেছিল? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
এসেছিল বই কী। সে নাছোড়বান্দা। এবার রুদ্রশেখরের সঙ্গে কথা বলেছে।
কী কথা হয়েছিল জানেন?
না। আর রুদ্র যদি বিক্রিও করতে চায়, আমাদের তো কিছু বলার নেই। তার নিজের ছবি সে যা ইচ্ছে করতে পারে।
কিন্তু সেটা সম্পত্তি পাবার আগে তো নয়, বলল ফেলুদা।
না, তা তো নয়ই।
খাবার সময় দুজন ভদ্রলোকের সঙ্গেই দেখা হল। রবীনবাবু সাংবাদিককে দেখে হঠাৎ কেন জানি চেনা-চেনা মনে হয়েছিল। হয়তো কোনও কাগজে ছবি-টবি বেরিয়েছে। কখনও। দাড়ি-গোঁফ কামানো, মাঝারি রং, চোখ দুটো বেশ উজ্জ্বল। বয়স ত্রিশ-পয়ত্ৰিশের বেশি না। বললেন অদ্ভুত সব তথ্য ধার করেছেন চন্দ্ৰশেখর নিয়োগী সম্বন্ধে। স্টুডিয়োতে একটা কাঠের বাক্সে নাকি অনেক মূল্যবান কাগজপত্র আছে।
রুদ্রশেখরবাবু থাকতে আপনার খুব সুবিধে হয়েছে বোধহয়? বলল ফেলুদা, ইটালির অনেক খবর তো আপনি এঁর কাছেই পাবেন।
ওঁকে আমি এখনও বিরক্ত করিনি, বললেন রবীনবাবু, উনি নিজে ব্যস্ত রয়েছেন। আপাতত আমি চন্দ্ৰশেখরের ভারতবর্ষে ফিরে আসার পরের অংশটা নিয়ে রিসার্চ করছি।
রুদ্রশেখরের মুখ দিয়ে একটা হুঁ ছাড়া আর কোনও শব্দ বেরোল না।
বিকেলে নবকুমারবাবুর সঙ্গে একটু বেড়াতে বেরিয়েছিলাম, কাছেই পোড়া ইটের কাজ করা দুটো প্রাচীর মন্দির আছে সেগুলো নাকি খুবই সুন্দর। ফটক দিয়ে বেরিয়ে গ্রামের রাস্তায় পড়তেই একটা কাণ্ড হল। পশ্চিম দিক থেকে ঘন কালো মেঘ এসে আকাশ ছেয়ে ফেলল, আর দশ মিনিটের মধ্যেই বজ্ৰপাতের সঙ্গে নামল তুমুল বৃষ্টি। লালমোহনবাবু বললেন এরকম ড্রামাটিক বৃষ্টি তিনি কখনও দেখেননি। সেটার একটা কারণ অবশ্য এই যে এ রকম খোলা প্রান্তরে বৃষ্টি দেখার সুযোগ শহরবাসীদের হয় না।
দৌড় দেওয়া সত্ত্বেও বৃষ্টির ফোঁটা এড়ানো গেল না। তারপর বুঝতে পারলাম যে এ বৃষ্টি সহজে ধরার নয়। আর আমাদের পক্ষে এই দুৰ্য্যেগের সন্ধ্যায় কলকাতায় ফেরাও সম্ভব নয়।