বাবাকে আপনার কথা বলেছি, সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে বললেন ভদ্রলোক। আপনারা আসছেন শুনে উনি খুব খুশি হলেন।
আর কে থাকেন এ বাড়িতে গ্ল জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।
সব সময় থাকার মধ্যে বাবা আর মা! মা-র জন্যেই থাকা। ওঁর শ্বাসের কষ্ট। কলকাতার ক্লাইমেট সহ্য হয় না। তা ছাড়া বঙ্কিমবাবু আছেন। বাবার সেক্রেটারি ছিলেন। এখন ম্যানেজার বলতে পারেন। আর চাকর-বাকার; আমি মাঝে মধ্যে আসি; এমনিতেওঁ আমি ফ্যামিলি নিয়ে আর ক’দিন পরেই আসতাম। এ বাড়িতে পুজো হয়, তাই প্রতিবারই আসি। এবারে একটু আগে এলাম। কারণ শুনলাম বাড়িতে অতিথি আছে-আমার কাকা, চন্দ্ৰশেখরের ছেলে, রোম থেকে এসেছেন। ক’দিন হল–তই মনে হল বাবা হয়তো একা ম্যানেজ করতে পারছেন না।
আপনার কাকার সঙ্গে আপনাদের যোগাযোগ আছে বুঝি?
একেবারেই না। এই প্রথম এলেন। বোধহয় দাদুর সম্পত্তির ব্যাপারে।
আপনার দাদু কি মারা গেছেন?
খবরাখবর নেই বহুদিন। বোধহয় মৃত বলেই ধরে নিতে হবে।
উনি রোম থেকে ফিরে এসে এখানেই থাকতেন?
হ্যাঁ।
কলকাতায় না থেকে এখানে কেন?
কারণ উনি যাদের ছবি আঁকতেন তারা সারা ভারতবর্ষে ছড়ানো। নেটিভ স্টেটের রাজা মহারাজা। কাজেই ওঁর পক্ষে কলকাতায় থাকার কোনও বিশেষ সুবিধে ছিল না।
আপনি আপনার দাদুকে দেখেছেন?
উনি যখন বাড়ি ছেড়ে চলে যান। তখন আমার বয়স ছয়। আমায় ভালবাসতেন। খুব এইটুকু মনে আছে।
বৈঠকখানায় আসবাবের চেহারা দেখে চোখ টেরিয়ে গেল। মাথার উপরে ঘরের দুদিকে দুটো ঝাড়লণ্ঠন রয়েছে যেমন আর আমি কখনও দেখিনি। একদিকের দেয়ালে প্রায় আসল মানুষের মতো বড় একটা পোট্রেট রয়েছে। একজন বৃদ্ধেরু-গায়ে জোব্বা, কোমরে তলোয়ার, মাথায় মণিমুক্ত বসানো পাগড়ি। নবকুমার বললেন। ওটা ওঁর প্রপিতামহ অনন্তনাথ নিয়োগীর ছবি। চন্দ্ৰশেখর ইন্টালি থেকে ফিরে এসেই ছবিটা এঁকেছিলেন। — ছেলে ইটালিয়ান মেয়ে বিয়ে করেছে শুনে অনন্তনাথ বেজায় বিরক্ত হয়েছিলেন। বলেছিলেন। আর কোনওদিন ছেলের মুখ দেখবেন না। কিন্তু শেষ বয়সে ওঁর মনটা অনেক নরম হয়ে যায়। দাদু বিপত্নীক অবস্থায় ফিরলে উনি দাদুকে ক্ষমা করেন, এবং উনিই দাদুর প্রথম সিটার।
আমি একটা কথা না জিজ্ঞেস করে পারলাম না।
এস, নিয়োগী লেখা দেখছি কেন? ওঁর নাম তো ছিল চন্দ্ৰশেখর।
রোমে গিয়ে ওঁর নাম হয়। সানড্রো। সেই থেকে ওই নামই লিখতেন নিজের ছবিতে।
পোস্ট্রেট ছাড়া ঘরে আরও ছবি ছিল এস, নিয়োগীয় আঁকা। আর্টের বইয়ে যে সব বিখ্যাত বিলিতি পেস্টারের ছবি দেখা যায়, তার সঙ্গে প্রায় কোনও তফাত নেই। বোঝাই যায় দুর্দান্ত শিল্পী ছিলেন সানড্রো নিয়োগী।
একজন চাকর শরবত নিয়ে এল। ষ্ট্রে থেকে একটা গেলাস তুলে নিয়ে ফেলুদা প্রশ্ন করল।
ওই প্ৰবন্ধটাতে ভদ্রলোক লিখেছেন চন্দ্ৰশেখরের ব্যক্তিগত সংগ্রহে নাকি কোনও বিখ্যাত বিদেশি শিল্পীর আঁকা একটি পেন্টিং ছিল। অবিশ্যি ভদ্রলোক শিল্পীর নাম বলেননি, কারণ চন্দ্ৰশেখরই নাকি ওঁকে বলতে বারণ করেছিলেন–বলেছিলেন বললে কেউ বিশ্বাস করবে: না। আপনি কিছু জানেন এই পেন্টিং সম্বন্ধে?
নবকুমারবাবু বললেন, দেখুন, মিস্টার মিত্ৰ-পেন্টিং একটা আছে। এটা আমাদের পরিবারের সকলেই জানে। বেশি বড় না। এক হাত বাই দেড় হাত হবে। একটা ক্রাইস্টের ছবি। সেটা কোনও বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা কি না বলতে পারব না। ছবিটা দাদু নিজের স্টুডিয়োর দেয়ালেই টাঙিয়ে রাখতেন, অন্য কোনও ঘরে টাঙানো দেখিনি কখনও।
অবিশ্যি যিনি প্রবন্ধটা লিখেছেন তিনি জানেন নিশ্চয়ই।
তা তো জানবেনই, কারণ ভগওয়ানগড়ের এই রাজার সঙ্গে দাদুর খুবই বন্ধুত্ব ছিল।
আপনার কাকা জানতেন না? যিনি এসেছেন?
নবকুমার মাথা নাড়লেন।
আমার বিশ্বাস বাপ আর ছেলের মধ্যে বিশেষ সম্ভাব ছিল না। তা ছাড়া কাকা বোধহয় আর্টের দিকে যাননি।
তার মানে ওই ছবির সঠিক মূল্যায়ণ এ বাড়িএ কেউ করতে পারবে না?
কাকা না পারলে আর কে পারবে বলুন। বাবা হলেন গানবাজনার লোক! বাতদিন ওই নিয়েই পড়ে থাকতেন। আর্টের ব্যাপারে আমার যা জ্ঞান, ওঁরাও সেই জ্ঞান; আর আমার ছোটভাই নন্দকুমার সম্বন্ধেও ওই একই কথা।
তিনিও গানবাজনা নিয়ে থাকেন বুঝি?
না। ওর হল অ্যাকটিং-এর নেশা। আমাদের একটা ট্র্যাভেল এজেন্সি আছে কলকাতায়। বাবাই করেছিলেন, আমরা দুজনেই পার্টনার ছিলাম তাতে। নন্দ সেভেস্টি-ফাইভে হঠাৎ সব ছেড়ে ছুড়ে বম্বে চলে যায়। ওর এক চেনা লোক ছিল ওখানকার ফিল্ম লাইনে। তাকে ধরে হিন্দি ছবিতে একটা অভিনয়ের সুযোগ করে নেয়। তারপর থেকে ওখানেই আছে।
সাকসেসফুল?
মনে তো হয় না। ফিল্ম পত্রিকায় গোড়ার দিকের পরে তো আর বিশেষ ছবিটবি দেখিনি ওর।
আপনার সঙ্গে যোগাযোগ আছে?
মোটেই না। শুধু জানি নেপিয়ান সি রোডে একটা ফ্ল্যাটে থাকে। বাড়ির নাম বোধহয় সি-ভিউ; মাঝে মাঝে ওর নামে চিঠি আসে। সেগুলো রিডাইরেক্ট করতে হয়। ব্যাস।
সরবত শেষ করে আমরা নবকুমারবাবুর বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম।
দক্ষিণের একটা চওড়া ঝরান্দায় একটা ইংরেজি পেপারব্যাক চোখের খুব কাছে নিয়ে আরাম কেদারায় বসে আছেন ভদ্রলোক।
আমাদের সঙ্গে পরিচয়ের পর ভদ্রলোক ছেলেকে বললেন, টুমরীর কথা বলেছিস এঁকে?
নবকুমারবাবু একটু অপ্রস্তুত ভাব করে বললেন, তা বলেছি। তবে ইনি এমনি বেড়াতে এসেছেন, বাবা।