বৈকুণ্ঠপুরের নিয়োগী পরিবারের একজনকে নিয়ে লেখা, বলল ফেলুদা, ভদ্রলোক ছবি আঁকতেন। রোমে গিয়ে আঁকা শিখেছিলেন।
আমার দাদু চন্দ্ৰশেখর, হেসে বললেন ভদ্রলোক। আমি ওই পরিবারেরই ছেলে। আমার নাম নবকুমার নিয়োগী।
আই সি। আমার নাম প্রদোষ মিত্ৰ। ইনি লালমোহন গাঙ্গুলী, আর ইনি আমার খুড়তুতো ভাই তপেশ।
প্রদোষ মিত্র শুনে ভদ্রলোকের ভুরু কুঁচকে গেল।
গোয়েন্দা প্রদোষ মিত্ৰ?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
তা হলে তো আপনাদের আসতেই হবে। আপনি তো বিখ্যাত লোক মশাই। সত্যি বলতে কী, এর মধ্যে আপনার কথা মনেও হয়েছিল একবার।
কেন বলুন তো?
একটা খুনের ব্যাপারে। আপনি শুনলে হাসবেন, কারণ ভিকটিম মানুষ নয়, কুকুর।
বলেন কী? কবে হল এ খুন?
গত মঙ্গলবার। আমাদের একটা ফক্স টেরিয়ার। বাবার খুবই প্রিয় কুকুর ছিল।
খুন মানে?
চাকরের সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়েছিল। আর ফেরেনি। চাকরও ফেরেনি। কুকুরের লাশ পাওয়া যায় বাড়ি থেকে মাইল খানেক দূরে, একটা বাঁশবনে। মনে হয় বিষাক্ত কিছু খাওয়ানো হয়েছিল। বিস্কিটের গুঁড়ো পড়ে ছিল আশেপাশে।
এ তো অদ্ভুত ব্যাপার। এর কোনও কিনারা হয়নি?
উহুঁ। কুকুরের বয়স হয়েছিল এগারো। এমনিতেই আর বেশিদিন বাঁচত না। আমার কাছে ব্যাপারটা তাই আরও বেশি মিস্টিরিয়াস বলে মনে হয়। যাই হাক, আপনাকে অবিশ্যি এ নিয়ে তদন্ত করতে হবে না, কিন্তু আপনারা এলে সত্যিই খুশি হব। দাদুর স্টুডিয়ো এখনও রয়েছে, দেখিয়ে দেব।
ঠিক আছে বলল ফেলুদা। আমারও লেখাটা পড়ে যথেষ্ট কৌতুহল হয়েছিল নিয়াগী পরিবার সম্বন্ধে। আমরা কাজ সেরে সাড়ে দশটা নাগাত গিয়ে পড়ব।
মেচেদার মোড় থেকে দু-কিলোমিটার গেলে একটা পেট্রল পাম্প পড়ে। সেখানে জিজ্ঞেস করলেই বৈকুণ্ঠপুরের রাস্তা বাতলে দেবে।
টায়ার লাগানো হয়ে গিয়েছিল। আমাদের গাড়ি আরও স্পিড়ে যাবে বলে ভদ্রলোক আমাদেরই আগে যেতে দিলেন। গাড়ি রওনা হবার পর ফেলুদা বলল, কত যে ইন্টারেস্টিং বাঙালি চরিত্র আছে যাদের নামও আমরা জানি না। এই চন্দ্ৰশেখর নিয়োগী বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে চব্বিশ বছর বয়সে রোমে চলে যান ওখানকার বিখ্যাত অ্যাকাডেমিতে পেন্টিং শিখতে। ছাত্র থাকতেই একটি ইটালিয়ান মহিলাকে বিয়ে করেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর দেশে ফিরে আসেন। এখানে পেট্রেট আঁকিয়ে হিসেবে খুব নাম হয়। নেটিভ স্টেটের রাজ-রাজড়াদের ছবি আঁকতেন। একটি রাজার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়। তিনিই লিখেছেন প্ৰবন্ধটা। প্রৌঢ় বয়সে আঁকাটাকা সব ছেড়ে দিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে চলে যান।
আপনি বলছেন চন্দ্ৰশেখরের কথা। আর আমি ভাবছি কুকুর খুন, বললেন লালমোহনবাবু। এ জিনিস শুনেছেন কখনও?
ফেলুদা স্বীকার করল সে শোনেনি।লেগে পড়ুন মশাই বললেন লালমোহনবাবু শাঁসালে মক্কেল। তিন তিনখানা ভিনটেজ গাড়ি। হাতের ঘড়িটা দেখলেন? কমপক্ষে ফাইভ থাউজ্যান্ড চিপস। এ দাঁও ছাড়বেন না।
০৩. ভবেশ ভট্টাচার্যের সঙ্গে
ভবেশ ভট্টাচার্যের সঙ্গে পোস্টকার্ডে অ্যাপায়েন্টমেন্ট করা ছিল, তাই তাঁর দর্শন পেতে দেরি হল, না! ইস্কুল মাস্টার টাইপের চেহারা, চোখে মোটা চশমা, গায়ে ফতুয়ার উপর একটা এন্ডির চাদর, বসেছেন তক্তপোশে, সামনে ডেস্কের উপর গোটা পাঁচেক ছুচোলো করে কাটা পেনসিল, আর একটা খোলা খেরোর খাতা।
লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায়?-পোস্টকার্ডে নামটা পড়ে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক। লালমোহনবাবু মাথা নাড়লেন।বয়স কত হল? লালমোহনবাবু বয়স বললেন।
জন্মতারিখ?
উনত্রিশে শ্রাবণ।
হুঁ…সিংহ রাশি। তা আপনার জিজ্ঞাসাটা কী?
আজ্ঞে আমি রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজে উপন্যাস লিখি। আমার আগামী উপন্যাসের তিনটি নাম ঠিক করা আছে। কোনটা ব্যবহার করব যদি বলে দেন।
কী কী নাম?
‘কারাকোরামে রক্ত কার?’, ‘কারাকোরামের মরণ কামড়’, আর ‘নরকের নাম কারাকোরাম’।
হুঁ। দাড়ান।
ভদ্রলোক নামগুলো খাতায় লিখে নিয়ে কী সব যেন হিসেব করলেন, তার মধ্যে যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ সবই আছে। তারপর বললেন, আপনার নাম থেকে সংখ্যা পাচ্ছি একুশ, আর জন্ম-মাস এবং জন্মতারিখ মিলিয়ে পাচ্ছি। ছয়। তিন সাতে একুশ, তিন দুগুণে ছয়। অর্থাৎ তিনের গুণণীয়ক না হলে ফল ভাল হবে না। আপনি তৃতীয় নামটাই ব্যবহার করুন। তিন আঠারং চুয়ান্ন। কবে বেরোচ্ছে বই?
আজ্ঞে পয়লা জানুয়ারি।
উঁহু। তেসরা করলে ভাল হবে, অথবা তিনের গুণণীয়ক যে-কোনও তারিখ।
আর, ইয়ে–বিক্রিটা–?
বই ধরবে।
একশোটি টাকা খামে পুরে দিয়ে আসতে হল। ভদ্রলোককে। লালমোহনবাবুর তাতে বিন্দুমাত্ৰ আক্ষেপ নেই। উনি ষোল আনা শিওর যে বই হিট হবেই। বললেন, মনের ভার নেমে গিয়ে অনেকটা হালকা লাগছে মশাই।
তার মানে এবার থেকে কি প্রত্যেক বই বেরোবার আগেই মেচেদা–?
বছরে দুটি তো! সাক্সেসের গ্যারান্টি যেখানে পাচ্ছি…
ভট্টাচার্য মশাইয়ের কাছে বিদায় নিয়ে একটা চায়ের দোকানে চা খেয়ে আমরা বৈকুণ্ঠপুর রওনা দিলাম। নবকুমারবাবুর নির্দেশ অনুযায়ী পেট্রল পাম্পে জিজ্ঞেস করে নিয়োগী প্যালেসে পৌঁছাতে লাগল বিশ মিনিট।
বাড়ির বয়স যে দুশো সেটা আর বলে দিতে হয় না। খানিকটা অংশ মেরামত করে রং করা হয়েছে সম্প্রতি, বাড়ির লোকজন বোধহয় সেই অংশটাতেই থাকে। দুদিকে পাম গাছের সারিওয়ালা রাস্তা পেরিয়ে বিরাট পোর্টিকের নীচে এসে আমাদের গাড়ি থামল। নবকুমারবাবু গাড়ির আওয়াজ পেয়েই নীচে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। একগাল হেসে আসুন আসুন বলে আমাদের ভিতরে নিয়ে গেলেন। আমরা কথা রাখব কি না। এ বিষয়ে তাঁর খানিকটা সংশয় ছিল এটাও বললেন।