অথচ পাসপোর্ট যদি জাল হয়, তা হলে চন্দ্ৰশেখরের সম্পত্তি পাবার ব্যাপারেও তিনি ব্যর্থ হতে বাধ্য, কারণ উকিলের কাছে তিনি কোনওদিনও প্রমাণ করতে পারবেন না যে তিনি চন্দ্ৰশেখরের ছেলে।
তা হলে তিনি এলেন কেন? কারণ একটাই-চন্দ্ৰশেখরের ব্যক্তিগত সংগ্রহের মহামূল্য ছবিটি হাত করার জন্য। ভূদেব সিং-এর প্রবন্ধের দৌলতে এ ছবির কথা আজ ভারতবর্ষের অনেকেরই জানা।
যিনি রুদ্রশেখরের ভেক ধরে এসেছিলেন, তিনি একটা কথা জানতেন না, যে কথাটা আমরা জেনেছি চন্দ্ৰশেখরের বাক্সে পাওয়া একটি ইটালিয়ান খবরের কাগজের কাটিং থেকে। এই খবরে বলা হয়েছে, আজ থেকে ছাব্বিশ বছর আগে রোম শহরে রুদ্রশেখরের মৃত্যু হয়।
অ্যাঁ!—নবকুমারবাবু প্ৰায় চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন।
আজ্ঞে হ্যাঁ, নবকুমারবাবু। আর খবরটার জন্য আমি রবীনবাবুর কাছে কৃতজ্ঞ।
তা হলে এখানে এসেছিল কে?
ফেলুদা এবার পকেট থেকে একটা কাগজ বার করল। একটা ম্যাগাজিনের পাতা।
হংকং-এ অত্যন্ত আকস্মিকভাবে এই পত্রিকার পাতাটা আমার চোখে পড়ে যায়। এই ভদ্রলোকের ছবিটা একবার দেখবেন কি নবকুমারবাবু? মোম্বাসা নামক একটি হিন্দি ফিল্মের ছবি এটা। ১৯৭৬-এর ছবি। এই ছবির অনেক অংশ আফ্রিকায় তোলা হয়েছিল। এতে ভিলেনের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন এই শ্মশ্ৰ-গুম্ফ বিশিষ্ট ভদ্রলোকটি। দেখুন তো একে চেনেন কি না।
কাগজটা হাতে নিয়ে নবকুমারবাবুর চোখ কপালে উঠে গেল।
এই তো রুদ্রশেখর!
নীচে নামটা পড়ে দেখুন।
নবকুমারবাবু নীচের দিকে চাইলেন।
মাই গড! নন্দ!
হ্যাঁ, নবকুমারবাবু। ইনি আপনারই ভাই! প্রায় এই একই মেক-আপে তিনি এসেছিলেন। রুদ্রশেখর সেজে। আসল দাড়ি-গোঁফ, নকল নয়। কেবল চুলটা বোধহয় ছিল পরচুলা। আসবার আগে তাঁর কোনও চেনা লোককে দিয়ে রোম থেকে একটা চিঠি লিখিয়েছিল। সৌম্যশেখরকে। এ কাজটা করা অত্যন্ত সোজা।
নবকুমারবাবুর অবস্থা শোচনীয়। বার বার মাথা নেড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, নন্দটা চিরকালই রেকলেস।
ফেলুদা বলল, আসল ছবি হঠাৎ মিসিং হলে মুশকিল হত, তাই উনি কলকাতা থেকে আর্টিস্ট আনিয়ে তার একটা কপি করিয়ে নিয়েছিলেন। কোনও কারণে বোধহয় বঙ্কিমবাবুর সন্দেহ হয়, তাই যেদিন ভোরে নন্দকুমার যাবেন সেদিন সাড়ে তিনটায় অ্যালার্ম লাগিয়ে স্টুডিয়োতে গিয়েছিলেন। এবং তখনই তিনি নিহত হন।
বৈঠকখানায় কিছুক্ষণের জন্য পিন-ড্রপ সাইলেন্স। তারপর ফেলুদা বলল, অবিশ্যি একজন ব্যক্তি নন্দবাবুকে আগেই ধরিয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু দেননি। কারণ তাঁর বোধহয় লজ্জা করছিল। তাই নয় কি?
প্রশ্নটা ফেলুদা করল। যাঁর দিকে চেয়ে তিনি মিনিটখানেক হল ঘরে এসে এক কোনায় একটা সোফায় বসেছেন।
সাংবাদিক রবীন চৌধুরী।
সত্যিই কি? আপনি সত্যিই পারতেন নন্দকে ধরিয়ে দিতে? নন্দকুমারব্বাবু প্রশ্ন করলেন।
রবীনবাবু একটু হেসে ফেলুদার দিকে চেয়ে বললেন, এতদূর যখন বলেছেন, তখন বাকিটাও আপনিই বলুন না।
আমি বলতে পারি, কিন্তু সব প্রশ্নের উত্তর তো আমার জানা নেই রবীনবাবু। সেখানে আপনার আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে।
বেশ তো, করব। আপনার কী কী প্রশ্ন আছে বলুন।
এক—আপনি যে সেদিন বললেন ইটালিয়ান কাগজের খবরটা পড়তে আপনার ডিকশনারির সাহায্য নিতে হয়েছিল, সেটা বোধহয় মিথ্যে, না?
হাঁ, মিথ্যে।
আর আপনার শার্টের বাঁ দিকে যে লাল রংটা লেগে রয়েছে, যেটাকে প্রথম দেখে রক্ত বলে মনে হয়েছিল, সেটা আসলে অয়েল পেস্ট, তাই না?
তাই।
আপনি পেন্টিং শিখেছিলেন বোধহয়?
হ্যাঁ।
কোথায়?
সুইটজারল্যান্ডে। বাবা মারা যাবার পর মা আমাকে নিয়ে সুইটজারল্যান্ডে চলে যান। মা নার্সিং শিখেছিলেন, জুরিখে একটা হাসপাতালে যোগ দেন। আমার বয়স তখন তেরো। আমি লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে আর্ট অ্যাকাডেমিতে ক্লাস করি।
কিন্তু বাংলাটা শিখলেন কোথায়?
সেটা আরও পরে। ১৯৬৬-তে আমি প্যারিসে যাই একটা আর্ট স্কুলের শিক্ষক হিসেবে। ওখানে কিছু বাঙালির সঙ্গে পরিচয় হয় এবং বাংলা শেখার ইচ্ছে হয়। শেষে সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার ক্লাসে যোগ দিই। ভাষার উপর আমার দখল ছিল, কাজেই শিখতে মুশকিল হয়নি। বছর দু-এক হল চন্দ্ৰশেখরের জীবনী লেখা স্থির করি। রোমে যাই। ভেনিসেও গিয়ে ক্যাসিনি পরিবারের সঙ্গে আলাপ করি। সেখানেই টিনটারেটার ছবিটার কথা জানতে পারি।
তার মানে আপনিও একটি কপি করেছিলেন টিনটোরেটা ছবির। এবং সেই কপিই হীরালাল সোমানি নিয়ে গিয়েছিল। হংকং-এ?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
তা হলে আসলটা কোথায়? চেঁচিয়ে উঠলেন নবকুমারবাবু।
ওটা আমার কাছেই আছে, বললেন রবীনবাবু।
কেন, আপনার কাছে কেন?
ওটা আমার কাছে আছে বলেই এখনও আছে, না-হলে হংকং চলে যেত। এখানে এসেই আমার সন্দেহ হয়েছিল যে ওটাকে সরাবার মতলব করছেন জাল-বিরুদ্রশেখর। তাই ওটার একটা কঁপি করে, আসলটাকে আমার কাছে রেখে কপিটকে ফ্রেমে ভরে টাঙিয়ে রেখেছিলাম।
ফেলুদা বলল, আসলটা তো আপনারই নেবার ইচ্ছে ছিল, তাই না?
নিজের জন্য নয়। আমি ভেবেছিলাম। ওটা ইউরোপের কোনও মিউজিয়ামে গিয়ে দেব। পৃথিবীর যে-কোনও মিউজিয়াম ওটা পেলে লুফে নেবে।
আপনি মিউজিয়ামে দেবেন। মানে? সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে বললেন নবকুমারবাবু।ওটা তো নিয়োগী পরিবারের সম্পত্তি।