কাঁপা হাত পকেটের মধ্যে ঢুকিয়ে চেকটা ঝর করে ক্রিকোরিয়ানের দিকে এগিয়ে দিলেন।
সাহেব যখন চেকটা ছিনিয়ে নিয়ে পকেটে পুরছেন, তখন সোমানির হাঁ করা মুখ আরও হাঁ করিয়ে দিয়ে ফেলুদা বলল–
এই যে আপনার সর্বনাশটা হল, হীরালালজি, এর জন্য কিন্তু আমি দায়ী নই, দায়ী তিনটি সবুজ পোকা।
১২. হংকং-এ হিমসিম
সবচেয়ে যেটা অবাক লাগছিল সেটা হল দ্বিতীয় ছবিটাও জাল বেরিয়ে পড়া। কিন্তু আশ্চর্য এটা নিয়ে ফেলুদা কোনও মন্তব্যই করল না। এমনিতে ছবিটা দেখে একেবারেই জাল বলে। মনে হয়নি। লালমোহনবাবু তো বললেন, ইটালিতে চারশো বছর আগে শ্যামাপোকা ছিল ন-এ ব্যাপারে আপনি এত শিওর হচ্ছেন কী করে? হয়তো পশ্চিম থেকেই আমদানি হয়েছে। এই পোকার। শুনিচি তো কচুরিপানাও এদেশে এককালে ছিল না, সেটা নাকি এসেছে এক মেমসাহেবের সঙ্গে।
এতেও ফেলুদা তার একপেশে হাসিটা ছাড়া কোনও মন্তব্য করল না।
পরদিন পূর্ণেন্দুবাবু এয়ারপোর্টে এলেন আমাদের সি-অফ করতে। ফেলুদা তাঁকে একটা ভাল টাই কিনে উপহার দিল। ভদ্রলোক বললেন, চব্বিশ ঘণ্টায় একটা ছোটখাটো ঝড় বইয়ে দিলেন মশাই হংকং-এ। তবে এর পরের বার আরেকটু বেশি দিন থাকতে হবে। আপনাদের সাপের মাংস না খাইয়ে ছাড়ছি না।
হংকং ছাড়তে সত্যিই ইচ্ছে করছিল না, কিন্তু আমি জানি ফেলুদা যে-কয়েকটা মন্ত্রে বিশ্বাস করে তার মধ্যে একটা হল ডিউটি ফাস্ট। এত রহস্যের সমাধান বাকি আছে–নকল খীশুর রহস্য, বঙ্কিমবাবু খুনের রহস্য, কুকুর খুনের রহস্য-সেগুলির একটা গতি না করে হংকং-ভোগ ফেলুদার ধাতে নেই।
বুধবার রাত্রে রওনা হয়ে বিষ্যুদবার দুপুর সাড়ে বারোটায় পৌঁছলাম। কলকাতা। এয়ারপোর্টেই লালমোহনবাবুকে বলে দেওয়া হয়েছিল যে আজকের দিনটা বিশ্রাম। কাল সকাল আটটা নাগাত ট্যাক্সিতে ওঁর বাড়িতে পৌঁছে যাব, সেখান থেকে ওঁর গাড়িতে বৈকুণ্ঠপুর। ফেরার পথে ফেলুদা একবার পার্ক স্ট্রিট পোস্ট আপিসে থামল। বলল, একটা জরুরি টেলিগ্ৰাম করার আছে; কাকে সেটা বলল না।
বাকি দিনটা ফেলুদার পেট থেকে আর কোনও কথা বার করা গেল না। ওর এই মীনী অবস্থাটা আমার খুব ভাল জানা আছে। এটা হচ্ছে ঝড়ের থমথমে পূর্ববস্থা। আমি নিজে অনেক ভেবেও কুলকিনারা পাইনি। এখনও যেই তিমিরে সেই তিমিরে। তার উপর এক’দিনের হংকং-এর ধাক্কায় এমনিতেই সব তালগোল পাকিয়ে গেছে, চোখ বুজলেই এখনও চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। আকাশের গায়ে ঝুলছে লম্বা লম্বা চিনে অক্ষর।
পরদিন বৈকুণ্ঠপুর পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় এগারোটা হয়ে গেল।
নবকুমারবাবু উদ্গ্ৰীব হয়ে হংকং-এর কথা জিজ্ঞেস করতে ফেলুদার মাথা নাড়তে হল।
ছবি পাওয়া যায়নি।
যেটা ছিল সেটাও জান, বলল ফেলুদা।
সে কী করে হয় মশাই? দু-দুটো জাল? তা হলে আসলটা গেল কোথায়?
আমরা সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। ফেলুদা বলল, ওপরে চলুন। বৈঠকখানায় বসে কথা হবে।
বৈঠকখানায় গিয়ে দেখি মহাদেব মণ্ডল বসে লেবুর সরবত খাচ্ছেন।
কী মশাই–মিশন সাকসেসফুল? প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক।
চোরাই মাল পাওয়া যায়নি। তবে সেটা আমারই ভুল। অন্য দিক দিয়ে সাকসেসফুল বই কী।
বটে? খুনি?
সে হয়তো নিজেই ধরা দেবে।
বলেন কী!
ফেলুদা আর চেয়ারে বসল না। আমাদের জন্যও ট্রে-তে সরবত এসেছিল, একটা গেলাস তুলে নিয়ে তাতে একটা চুমুক দিয়ে টেবিলে নামিয়ে রেখে ফেলুদা পকেট থেকে খাতাটা বার করল। আমরা সবাই ওকে ঘিরে সোফায় বসেছি।
আমার মনে হয় শুরু থেকেই শুরু করা ভাল, বলল ফেলুদা। তারপর খাতাটা একটা বিশেষ পাতায় খুলে সেটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল–
২৮শে সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার বৈকুণ্ঠপুরে দুটো ঘটনা ঘটে–নবকুমারবাবুদের ফক্স টেরিয়ার ঠুমরীকে কে জানি বিষ খাইয়ে মারে, আর চন্দ্ৰশেখরের ছেলে রুদ্রশেখর বৈকুণ্ঠপুরে আসেন। এটা একই দিনে ঘটায় আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল এই দুটোর মধ্যে কোনও যোগ আছে কি না। একটা পোষা কুকুরকে কে মারতে পারে এবং কেন মারতে পারে, এই প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে গিয়ে দুটো উত্তর পেলাম। কোনও বাড়ির কুকুর যদি ভাল পাহারাদার হয়, তা হলে সে বাড়ি থেকে কিছু চুরি করতে হলে চোর কুকুরকে আগে থেকে সরিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু এখানে চুরি যেটা হয়েছে সেটা কুকুর মারা যাবার অনেক পরে। তাই আমাকে দ্বিতীয় কারণটার কথা ভাবতে হল। সেটা হল, কোনও ব্যক্তি যদি তার পরিচয় গোপন করে ছদ্মবেশে কোনও বাড়িতে আসতে চায়, এবং সে ব্যক্তি যদি সে বাড়ির কুকুরের খুব চেনা হয়, তা হলে কুকুর ব্যাঘাতের সৃষ্টি করতে পারে। এবং সেই কারণে কুকুরকে সরানোর প্রয়োজন হতে পারে। কারণ, কুকুর প্রধানত মানুষ চেনে মানুষের গায়ের গন্ধ থেকে এবং এই গন্ধ ছদ্মবেশে ঢাকা পড়ে না।
তখনই মনে হল রুদ্রশেখর হয়তো আপনাদের চেনা লোক হতে পারে। তার হাবভাবেও এ বিশ্বাস আরও বদ্ধমূল হল। তিনি কথা প্রায় বলতেন না, ঘোলাটে চশমা ব্যবহার করতেন, পারতে কারুর সামনে বেরোতেন না। তা হলে এই রুদ্রশেখর আসলে কে? তিনি ইটালি থেকে এসেছেন, অথচ পয়ে ব্যাটার জুতো পরেন। তিনি তাঁর পাসপোর্ট আপনার বাবাকে দেখিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু আপনার বাবা চোখে ভাল দেখেন না, এবং চক্ষুলজ্জার খাতিরে পাসপোর্ট খুঁটিয়ে দেখবেন না, তাই জাল পাসপোর্ট চালানো খুব কঠিন নয়।