আরও কিছুক্ষণ যাবার পর পূর্ণেন্দুবাবু বললেন, এইবার বাড়ির নম্বরটা দেখে নিতে হবে।
গাছপালা বাগানে ঘেরা দারুণ সুন্দর সুন্দর সব পুরনো বাড়ি, দেখলেই মনে হয় সাহেবদের জন্য সাহেবদেরই তৈরি। তারই একটা বাড়ির গেটের সামনে এসে নম্বর দেখে বুঝলাম ক্রিকোরিয়ানের বাড়িতে এসে গেছি। আর এসেই দেখলাম ভিতরে পোর্টিকের এক পাশে একটা কালো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে যেটা আমাদের চেনা। আমরা যখন সকালে পূর্ণেন্দুবাবুর গাড়ি থেকে নামছি, তখন এই গাড়িটাই আমাদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।
হীরালাল সোমানির গাড়ি।
আমাদের গাড়িটা আরেকটু এগিয়ে নিয়ে গিয়ে রাস্তার ধারে একটা গাছের তলায় পার্ক করে পূর্ণেন্দুবাবু বললেন, সাহেবের বাড়িটার দিকে চোখ রাখার জন্য একটা গোপন জায়গা বার করতে হবে।
সেরকম একটা জায়গা পেয়েও গেলাম।
তবে বেশিক্ষণ আড়ি পাততে হল না।
মিনিটখানেকের মধ্যেই বাড়ির সামনের দরজাটা খুলে যাওয়াতে তার থেকে একটা চতুষ্কোণ আলো বেরিয়ে পড়ল বাগানের ঘাসের উপর, আর তার পরেই নেপথ্যে বলা গুড নাইটের সঙ্গে সঙ্গে হীরালাল নিজেই বেরিয়ে এসে তাঁর গাড়িতে উঠলেন, আর গাডিও রওনা দিল বিলিতি এঞ্জিনের মৃদু গভীর শব্দ তুলল।
এবার কী করবেন? ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করলেন পূর্ণেন্দুবাবু।
সাহেবের সঙ্গে দেখা করব, বলল ফেলুদা।
আমরা আড়াল থেকে বেরিয়ে এগিয়ে গিয়ে সাহেবের গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম।
পোর্টিকোর দিকে এগোচ্ছি এমন সময় হঠাৎ এক অদ্ভুত ব্যাপার হল।
বাড়ির দরজা আবার খুলে গিয়ে উদভ্ৰান্ত ভাবে সাহেব স্বয়ং বেরিয়ে এসে আমাদের সম্পূর্ণ অগ্ৰাহ্য করে দৌড়ে এগিয়ে গেলেন গেটের দিকে। সাহেবের হাতে গিল্টিকরা নতুন ফ্রেমে বাঁধানো টিনটোরেটোর যীশু।
গেট থেকে বেরিয়ে রাস্তার দিকে একবার চেয়ে মাথায় হাত দিয়ে সাহেব চেঁচিয়ে উঠলেন—স্কাউভুল! সুইন্ডলার। সান-অফ-এ-বিচ!
তারপর আমাদের দিকে ফিরে দিশেহারা আধ-পাগলা ভাব করে বললেন, হি হ্যাঁজ জাস্ট সোল্ড মি এ ফেক—অ্যান্ড আই পেড ফিফটি থাউজ্যান্ড ডলারস ফর ইট।
অর্থাৎ লোকটা আমাকে এক্ষুনি একটা জাল ছবি বিক্রি করে গেল, আর আমি ওকে তার জন্য পঞ্চাশ হাজার ডলার দিলাম।
আমরা কে, কেন এসেছি তার বাড়িতে, এসব জানার কোনও প্রয়োজন বোধ করলেন না সাহেব।
তুমি কি টিনটারেটার ছবিটার কথা বলছ? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল। সাহেব। আবার বোমার মতো ফেটে পড়লেন।
টিনটারেটা? টিনটারেটা মাই ফুট! এসো, তোমাকে দেখাচ্ছি, এসো!
সাহেব দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন পোর্টিকোর দিকে। আমরা চারজন তাঁর পিছনে।
পোর্টিকোর আলোতে সাহেব ছবিটা তুলে ধরলেন।
লুক অ্যাট দিস। থ্রি গ্রিন ফ্লাইজ স্টিকিং টু দ্য পেন্ট—থ্রি গ্রিন ফ্রাইজ! এই পোকা আমার জীবন অতিষ্ঠা করে তুলেছিল কলকাতার গ্র্যান্ড হোটেলে! সেই পোকা আটকে আছে এই ছবির ক্যানভাসে। আর লোকটা বলে কিনা ছবিটা জেনুইন!—হি ফুলড মি, বিকজ ইটস এ গুড কপি—বাট ইটস এ কপি।
ঠিক বলেছ বলল ফেলুদা, ষোড়শ শতাব্দীতে ইটালিতে এ পোকা থাকা সম্ভব না।
পোটিকের আলোতে দেখতে পাচ্ছি সাহেবের সাদা মুখ লাল হয়ে গেছে। —দ্যাট ডাটি ডাবল ক্রসিং সোয়াইন! লোকটার ঠিকানাটা পর্যন্ত জানি না।
ঠিকানা আমি জানি, বললেন পূর্ণেন্দুবাবু।
জান? সাহেব যেন ধড়ে প্ৰাণ পেলেন।
হ্যাঁ, জানি। কাউলুনে থাকেন। ভদ্রলোক। হানয় রোড।
গুড। দেখি ব্যাটা কী ভাবে পার পায়। আইল স্কিন হিম অ্যালাইভ।
তারপর সাহেব হঠাৎ ফেলুদার দিকে চেয়ে বললেন, হু আর ইউ?
আমরা জানতাম ছবিটা জাল, তাই আপনাকে সাবধান করে দিতে আসছিলাম-— অম্লানবদনে মিথ্যে কথা বলল ফেলুদা।
কিন্তু তাকে তো ধরা যেতে পারে, হঠাৎ বললেন পূর্ণেন্দুবাবু, এক্ষুনি চলুন না। আমার গাড়ি আছে। লোকটা এখনও বেশি দূর যায়নি।
সাহেবের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।
লেট্স গো!
আসবার সময় চড়াই বলে বেশি স্পিড দেওয়া সম্ভব হয়নি; উতরাই পেয়ে পূর্ণেন্দুবাবু দেখিয়ে দিলেন তারাবাজি কাকে বলে। সোমানির পকেটে পঞ্চাশ হাজার ডলারের চেক, তার কাজ উদ্ধার হয়ে গেছে, তার আর তাড়া থাকবে কেন? পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটা মোড় ঘুরেই দেখতে পেলাম চেনা গাড়িটাকে।
পূর্ণেন্দুবাবু, আরেকটু স্পিড বাড়িয়ে গাড়িটার একেবারে পিছনে এসে পড়লেন। তারপর বার কয়েক হর্ন দিতেই সোমানির গাড়ি পাশ দিল। পূর্ণেন্দুবাবু ওভারটেক করে নিজের গাড়িটাকে টেরচাভাবে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দিলেন।
ব্যাপারটা দেখে সোমানি গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে, ক্রিকোরিয়ানও নেমেছেন ছবিটা হাতে নিয়ে, আর সেই সঙ্গে ফেলুদাও।
এক্সকিউজ মি!
ফেলুদা ক্রিকোরিয়ানের হাত থেকে ছবিটা নিয়ে নিল। ক্রিকোরিয়ান যেন বাধা দিতে গিয়েও পারল না।
তারপর বড় বড় পা ফেলে সোমানির দিকে এগিয়ে গিয়ে কী হচ্ছে সেটা বোঝার আগেই দেখলাম ছবি সমেত ফেলুদার হাত দুটো মাথার উপর উঠল, আর সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বেগে নেমে এল সোমানির মাথার উপর।
দিশি ক্যানভাস ফুঁড়ে সোমানির মাথাটা বেরিয়ে এল। বাইরে, আর ছবির গিল্টিকরা ফ্রেমটা হয়ে গেল। হতভম্ব ভদ্রলোকের গলার মালা।
এবার উনি আপনাকে আপনার চেকটা ফেরত দেবেন।
ফেলুদার হাতে এখন রিভলভার।
সোমানির হতভম্ব ভাবটা এখনও কাটেনি, কিন্তু ফেলুদার কথা বুঝতে ওঁর কোনও অসুবিধে হল না।