মিটারে ভাড়া বলছে হংকং ডলারে, সেটা হিসেব করে দাঁড়ায় প্রায় একশো টাকার মতো। উপায় নেই। তাই দিয়ে আমরা তিনজন মাল নিয়ে নেমে পড়লাম। আমি আর লালমোহনবাবুর দিকে চাইছি না, জানি তাঁর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, হংকং-এ ক্রাইমের বাড়াবাড়ি সম্বন্ধে যা কিছু শুনেছেন সবই এখন বিশ্বাস করছেন।
যে গলিটার দিকে ড্রাইভার দেখিয়েছে সেটায় সূর্যের আলো কোনওদিন প্রবেশ করে কি না জানি না; অন্তত এখন তো নেই।
আমরা মোড় ঘুরে গলিটায় ঢুকলাম, আর ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কেখেকে করা যেন এসে আমাদের ঘিরে ফেলল, আর তার পরমুহূর্তেই মাথায় একটা মোক্ষম বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে ব্ল্যাক-আউট।
যখন জ্ঞান হল তখন বুঝতে পারলাম একটা ঘূপচি ঘরের মেঝেতে পড়ে আছি। ফেলুদা আমার পাশে একটা কাঠের প্যাকিং কেসের উপর বসে চারমিনার খাচ্ছে। একটা অদ্ভুত গন্ধে মাথাটা কীরকম ভার ভার লাগছে। পরে জেনেছিলাম সেটা আফিং-এর গন্ধ। ব্রিটিশরা নাকি ভারতবর্ষের আফিং চিনে বিক্রি করে প্রচুর টাকা করেছিল, আর সেই সঙ্গে চিনেদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল আফিং-এর নেশা।
লালমোহনবাবু এখনও অজ্ঞান, তবে মাঝে মাঝে নড়ছেন-চড়ছেন, তাই মনে হয় এবার জ্ঞান ফিরবে।
আমাদের মালপত্ৰ? নেই।
ঘরে গোটাপাঁচেক ছোট বড় প্যাকিং কেস, একটা কগত হয়ে পড়ে থাকা বেতের চেয়ার, দেয়ালে একটা চিনে ক্যালেন্ডার-ব্যস, এ ছাড়া কিছু নেই। বাঁ দিকের দেয়ালে প্রায় দেড় মানুষ উঁচুতে একটা ছোট্ট জানালা, তাই দিয়ে ধোঁয়া মেশানো একটা ফিকে আলো আসছে। বোঝা যাচ্ছে দিনের আলো এখনও ফুরোয়নি। ডাইনে আর সামনে দুটো দরজা, দুটোই বন্ধ। শব্দের মধ্যে মাঝে মাঝে একটা পাখির ডাক শুনতে পাচ্ছি। চিনেরা খাঁচায় পাখি রাখে। এটা অনেক জায়গায় লক্ষ করেছি, এমন কী দোকানেও।
উঠুন লালমোহনবাবু, বলল ফেলুদা, আর কত ঘুমোবেন।
লালমোহনবাবু চোখ খুললেন, আর সঙ্গে সঙ্গে চোখ কুঁচকোনোতে বুঝলাম মাথার যন্ত্রণাটা বেশ ভাল ভাবেই অনুভব করছেন।
উঃ, কী ভয়ংকর অভিজ্ঞতা! কোনওমতে উঠে বসে বললেন ভদ্রলোক। এ কোথায় এনে ফেলেছে আমাদের?
গুম ঘর, বলল ফেলুদা।একেবারে আপনার গল্পের মতো, তাই না?
আমার গল্প? ছোঃ!
ছোঃ বলতেই বোধহয় মাথাটা একটু ঝনঝনি করে উঠেছিল, তাই নাকটা কুঁচকে একটু থেমে। এবার গলাটা খানিকটা নামিয়ে নিয়ে বললেন—
যা ঘটল। তার কাছে গল্প কোন ছার? সব ছেড়ে দেব মশাই। ঢের হয়েছে। হন ডুরাস ড্যাড্যাড্যাং, ক্যাম্বোডিয়ায় কচকচি আর ভ্যানকুভারের ভ্যানভ্যাননি—দুর্ দুর্!
আর লিখবেন না বলছেন?
নেভার।
আপনার এই স্টেটমেন্ট কিন্তু রেকর্ড হয়ে গেল। এর পরে আবার লিখলে কিন্তু কথার খেলাপ হবে।
ফেলুদার পাশেই রাখা আছে তার নতুন কেনা। ক্যাসেট রেকডার। আর কিছু করার নেই তাই ওটা নিয়েই খুঁটুর খাটুর করছে। রেকর্ডিং-এর কথাটা যে মিথ্যে বলেনি সেটা ও প্লে-ব্যাক করে জানিয়ে দিল।
এ তো সোমানিরই কীর্তি বলে মনে হচ্ছে, বললেন লালমোহনবাবু।
নিঃসন্দেহে। এখন আমাদের লাগেজটা ফেরত পেলে হয়। রিভলভারটা গেছে। কী ভাগ্যি রেকর্ডারটা নেয়নি।
দুটো যে দরজা দেখছি, দুটোই কি বন্ধ?
সামনেরটা বন্ধ। পাশেরটা খোলা যায়। ওটা বাথরুম।
ওটাতে পালাবার পথ নেই বোধহয়?
দরজা একটা আছে। বাইরে থেকে বন্ধ। জানালা দিয়ে মাথা গলবে, ধড় গলবে না।
লালমোহনবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের উপর মাথা রেখে আবার শুয়ে পড়লেন।
মিনিট খানেক পরে দেখি ভদ্রলোক গুনগুন করে গান গাইছেন। অনেক কষ্টে চিনতে পারলাম গানটা। হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল পার কর আমারে।
কড়িকাঠের দিকে চেয়ে কী ভাবছেন মশাই?
মাথায় ঘা খেয়ে অজ্ঞান হয়েও যে লোকে স্বপ্ন দেখে সেটা এই এক্সপেরিয়েন্সটা না হলে জানতুম না।
কী স্বপ্ন দেখলেন?
এক জায়গায় ডজনখানেক বাঁদর বিক্রি হচ্ছে, আর একটা লোক ডুগডুগি বাজিয়ে বলছে—রেনেসাঁসকা সুবাসিত বান্দর—রেনেসাঁসকা সুবাসিত বান্দর—দো দো ডলার—দো দো–
ঘরের বাইরে পায়ের শব্দ। সিঁড়ি দিয়ে উঠছে লোক। তার মানে বাইরে বারান্দা।
সামনের দরজা চাবি দিয়ে খোলা হল।
একজন কালো সুট পরা ভদ্রলোক এসে ঢুকলেন। পিছনে আবছা অন্ধকারে আরও দুটো লোক রয়েছে দেখতে পাচ্ছি। তিনজনেই ভারতীয়।
যিনি ঢুকলেন তিনি হচ্ছেন। হীরালাল সোমানি। চোখে মুখে বিশ্ৰী একটা বিদ্রূপের হাসি।
কী, মিস্টার মিত্তির? কেমন আছেন?
আপনারা যেমন রেখেছেন।
আপনি ঘাবড়াবেন না। আপনাকে লাইফ ইমপ্রিজনমেন্ট দিইনি। আমি। আমার কাম হয়ে গেলেই খালাস করে দেব।
আমাদের মালগুলো সরিয়ে রাখার কী কারণ বুঝতে পারলাম না।
দ্যাট ওয়জ এ মিসটেক; কানহাইয়া! কানহাইয়া!
দুজন লোকের একজন কোথায় চলে গিয়েছিল, সে ডাক শুনে ফিরে এল। এতক্ষণে বুঝতে পারছি যে অন্য লোকটি সোমানির পিছনে দাঁড়িয়ে রিভলভার উঁচিয়ে রয়েছে।
ইনলোগক সামান লাকে রুখ দৌ ইস্ কামরোমে, কানহাইয়াকে আদেশ করলেন হীরালাল। তারপর ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, এখানে ডিনারের অ্যারেঞ্জমেন্ট একটু মুশকিল হবে। আজ রাতটা ফাস্ট করুন। কাল থেকে আবার খাবেন, কেমন?
কানহাইয়া লোকটা আমাদের ব্যাগগুলো এবার ঘরের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিল।
বেশি ঝামেলা করবেন না মিস্টার মিত্তির। রাধেশ্যাম হ্যাঁজ ইওর রিভলভার। উয়ো আলতু ফালতু আদমি নহী হ্যায়। গোলি চালাতে জানে। আর মনে রাখবেন কি হংকং ইজ নট ক্যালকাটা। প্রদোষ মিটার ইজ নোবডি হিয়ার। আমি চলি। কাল সকালে দশটার সময় এসে এরা আপনাদের ফ্রি করে দেবে। গুড নাইট।