কী জিনিস মশাই? লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।এরা তো আরশোলাটারশোলাও খায় বলে শুনিচি।
শুধু আরশোলা কেন, বলল ফেলুদা, আরশোলা, হাঙরের পাখনা, বাঁদরের ঘিলু, এমন কী সময় সময় কুকুরের মাংস পর্যন্ত।
স-স-স-স্নেক? লালমোহনবাবুর চোখ-নাক সব একসঙ্গে কুঁচকে গেল।
স্নেক।
মানে সাপ? সাপ?
সৰ্প। সাপের সুপ, সাপের মাংস, ফ্রাইড স্নেক-সব পাওয়া যায়।
খেতে ভাল?
অপূর্ব। ব্যাঙের মাংস তো অতি সুস্বাদু জিনিস, জানেন বোধহয়। তা ব্যাঙের ভক্ষক কেন ভাল হবে না খেতে বলুন।
লালমোহনবাবু যদিও বললেন তা বটে, কিন্তু যুক্তি পুরোপুরি মানলেন বলে মনে হল না।
ফেলুদা উঠে পড়েছে।
যদি কিছু মনে না করেন—আপনার টেলিফোনটা….
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।
ফেলুদা আর্মেনিয়ান সাহেবের নম্বরটা ডায়াল করল। এ ডায়ালিং আমাদের মতো ঘুরিয়ে ডায়ালিং নয়। এটা বোতাম টিপে ডায়ালিং, টেপার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন নম্বরে বিভিন্ন সুরে একটা পি শব্দ হয়।
আমি একটু ক্রিকোরিয়ান সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
কোথায় গেছেন?
তাইওয়ান।
কবে।
গত শুক্রবার; আজি সন্ধ্যায়, ফিরবেন।
থ্যাঙ্ক ইউ।
ফেলুদা ফোন রেখে তারপর কী কথা হয়েছে সেটা বলল আমাদের।
তার মানে সে ছবি তো এখনও সোমানির কাছেই আছে, বললেন পূর্ণেন্দুবাবু।
তই তো মনে হচ্ছে বলল, ফেলুদা। তার মানে আমাদের এখানে আসাটা ব্যর্থ হয়নি।
১১. পূর্ণেন্দুবাবু বললেন
ইয়ুং কিং রেস্টোরান্টে আমাদের দুর্দান্ত ভাল চিনে খাবার খাইয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে পূর্ণেন্দুবাবু বললেন, আপনাদের তিনটের আগে যখন হোটেলে যাবার দরকার নেই তখন কিছু কেনাকাটার থাকলে এই বেলা সেরে নিন। অবিশ্যি কালকেও সময় পাবেন। আপনাদের ফ্লাইট তো সেই রাত দশটায়।
কিনি বা না কিনি, দু-একটা দাকানে অন্তত একটু উঁকি দিতে পারলে ভাল হত, বলল ফেলুদা।
আমার দোকানে নিয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু সে তো ভারতীয় জিনিস। আপনাদের ইন্টারেস্ট হবে না বোধহয়।
লালমোহনবাবুর একটা পকেট ক্যালকুলেটার কেনার শখ-বইয়ের বিক্রির হিসেবটা নাকি চেক করতে সুবিধে হয়–তাই ইলেকট্রনিক্সের দোকানেই যাওয়া স্থির হল!
আমার চেনা দাকানে নিয়ে যাচ্ছি বললেন পূর্ণেন্দুবাবু, জিনিসও ভাল পাবেন, দামেও এদিক ওদিক হবে না।
ফেলুদা আর লালমোহনবাবু দুজনেই তাদের প্রাপ্য পাঁচশো ডলার নিয়ে এসেছেন সঙ্গে করে। তাই হংকং-এর মতো জায়গা থেকে কিছু কেনা হবে না এটা হতেই পারে না।
লী ব্ৰাদারসে ইলেকট্রনিক্স-এর সব কিছু ছাড়াও ক্যামেরার জিনিসপত্রও পাওয়া যায়। আমার সঙ্গে ফেলুদার পেনাট্যাক্স, তার জন্য কিছু রঙিন ফিল্ম কিনে নিলাম। আজ আর সময় হবে না, কিন্তু কাল মা-বাবার জন্যে কিছু কিনে নিতে হবে। লালমোহনবাবু যে ক্যালকুলেটারটা কিনলেন সেটা এত ছোট আর চ্যাপটা যে তার মধ্যে কোথায় কী ভাবে ব্যাটারি থাকতে পারে সেটা আমার মাথায় ঢুকল না। ফেলুদা একটা ছোট্ট সোনি ক্যাসেট রেকডাঁর কিনে আমাকে দিয়ে বলল, এবার থেকে মক্কেল এলে এটা অন করে দিবি। কথাবার্তা রেকর্ড করা থাকলে খুব সুবিধে হয়।
দোকানের পাট সেরে তিনটে নাগাদ আবার পূর্ণেন্দুবাবুর বাড়িতে গিয়ে আমাদের মালপত্র তুলে রওনা দিলাম। পূর্ণেন্দুবাবুকে একবার দাকানে যেতে হবে, এবং সেটা আমাদের হোটেলের উলটো দিকে, তাই আমরা ট্যাক্সিতেই যাব পার্ল হোটেলে।
আমি কিন্তু চিন্তায় থাকব। মশাই বললেন পূর্ণেন্দুবাবু।কী হল না-হল একটা ফোন করে জানিয়ে দেবেন।
রাস্তায় বেরিয়ে সামনেই একটা ট্যাক্সি পাওয়া গেল। মাথাটা রুপোলি, গা-টা লাল–এই হল হংকং ট্যাক্সির রং। লম্ব আমেরিকান গাড়ি, তিনজনে উঠে। পিছনে বসলাম।
পার্ল হোটেল, বলল ফেলুদা।
ট্যাক্সি ফ্ল্যাগ ডাউন করে চলতে আরম্ভ করল।
লালমোহনবাবুর কিছুক্ষণ থেকেই একটা ঝিম-ধরা নেশা-করা ভাব লক্ষ করছিলাম। জিজ্ঞেস করতে বললেন সেটা অল্প সময়ে মনের প্রসার প্রচণ্ড বেড়ে যাওয়ার দরুন। আর বাড়লে নাকি সামলানো যাবে না। —কলকাতায় কেবল চিনে ছুতোর মিস্ত্রি আর চিনে জুতোর দোকানের কথাই শুনিচি। তারা যে এমন একখানা শহর গড়তে পারে সেটা চক্ষুষ না দেখলে বিশ্বাস করতুম না মশাই।
পূর্ণেন্দুবাবু বলেছিলেন পায়ে হেঁটে পার্ল হোটেলে যেতে লাগে পাঁচ মিনিট। অলি গলি দিয়ে দশ মিনিট চলার পরেও যখন পার্ল হোটেল এল না, তখন বেশ ঘাবড়ে গেলাম। ব্যাপার কী? ফেলুদা আরেকবার গলা চড়িয়ে বলে দিল, পার্ল হোটেল। উই ওয়ন্ট পার্ল হোটেল।
উত্তর এল-ইয়েস, পার্ল হোটেল। কালো কোট, কালো চশমা পরা ড্রাইভার, ভুল শুনেছে এটাও বলা চলে না, আর একই নামে দুটো হোটেল থাকবে সেটাও অবিশ্বাস্য।
প্রায় কুড়ি মিনিট চলার পর ট্যাক্সিটা একটা রাস্তার মোড়ে এসে থামল।
এটা যে একেবারে চিনে পাড়া তাতে কোনও সন্দেহ নেই। রাস্তার দু-দিকে সারবাঁধা আট-দশ তলা বাড়ি। সেগুলোর প্রত্যেকটির জানালায় ও ছোট ছোট ব্যালকনিতে কাপড় শুকোচ্ছে, বাইরে থেকেই বোঝা যায়। ঘরগুলোতে বিশেষ আলো বাতাস ঢোকে না; দোকান যা আছে তার মধ্যে টুরিস্টের মাথা-ঘোরানো হংকং-এর কোনও চিহ্ন নেই। সব দোকানের নামই চিনে ভাষায় লেখা, তাই বাইরে থেকে কীসের দোকান তা বোঝার উপায় নেই।
পার্ল হোটেল—হায়্যার? ফেলুদা জিজ্ঞেস করল।
লোকটা হাত বাড়িয়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল সামনের ডাইনের গলিটায় যেতে হবে।