হংকং মানে কী জানেন তো? জিজ্ঞেস করলেন পূর্ণেন্দুবাবু।
সুবাসিত বন্দর, বলল ফেলুদা। বুঝলাম ও খবরটা পেয়েছে ওই বইটা থেকে।
বেশ কিছুক্ষণ এই পথে চলার পর টানেল থেকে বেরিয়ে দেখলাম ছোট বড়-মাঝারি নানারকম জলযান সমেত পুরো বন্দরটা আমাদের পাশে বিছিয়ে রয়েছে, আর তারও পিছনে দূরে দেখা যাচ্ছে ফেলে আসা কাউলুন শহর।
আমাদের বাঁয়ে এখন বিশাল হাইরাইজ। কোনওটা আপিস, কোনওটা হোটেল, প্রত্যেকটারই নীচে লোভনীয় জিনিসে ঠাসা দোকানের সারি। পরে বুঝেছিলাম পুরো হংকং শহরটিা একটা অতিকায় ডিপার্টমেন্ট স্টোরের মতো! এমন কোনও জিনিস নেই। যা হংকং-এ পাওয়া যায় না।
কিছুদূর গিয়ে বাঁয়ে ঘুরে দুটো হাইরাইজের মাঝখান দিয়ে আমরা আরেকটা বড় রাস্তায় গিয়ে পড়লাম।
এমন রাস্তা আমি কখনওই দেখিনি।
ফুটপাথ দিয়ে চলেছে কাতারে কাতারে লোক, আর রাস্তা দিয়ে চলেছে ট্যাক্সি, বাস, প্রাইভেট গাড়ি আর ডবলডেকার-ট্রাম। ট্রামের মাথা থেকে ডাণ্ডা বেরিয়ে তারের সঙ্গে লাগানো, কিন্তু রাস্তায় লাইন বলে কিছু নেই। রাস্তার দুপাশে রয়েছে দোকানের পর দোকান! তাদের সাইনবোর্ডগুলো দোকানের গা থেকে বেরিয়ে আমাদের মাথার উপর এমন ভাবে ভিড় করে আছে যে আকাশ দেখা যায় না। চিনে ভাষা লেখা হয় ওপর থেকে নীচে, তাই সাইনবোর্ডগুলোও ওপর থেকে নীচে, তার একেকটা আট-দশ হাত লম্বা।
ট্র্যাফিক প্রচণ্ড, আমাদের গাড়িও চলেছে। ধীরে, তাই আমরা আশ মিটিয়ে দেখে নিচ্ছি। এই অদ্ভুত শহরের অদ্ভুত রাস্তার চেহারাটা। কলকাতার ধরমতলাতেও ভিড় দেখেছি, কিন্তু সেখানে অনেক লোকের মধ্যেই যেন একটা যাচ্ছি-যাব ভাব, যেন তাদের হাতে অনেক সময়, রাস্তাটা যেন তাদের দাঁড়িয়ে আড়ড়া মারার জায়গা। এখানের লোকেরা কিন্তু সকলেই ব্যস্ত, সকলেই হাঁটছে, সকলেরই তাড়া। বেশির ভাগই চিনে, তাদের কারুর চিনে পোশাক, কারুর বিদেশি পোষাক। এদেরই মধ্যে কিছু সাহেব-মেমও আছে। তাদের হাতে ক্যামেরা, চোখে কীতুহলী দৃষ্টি আর মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে এদিক ওদিক ঘাড় ঘোরানো থেকেই বোঝা যায় এরা টুরিস্ট।
অবশেষে এ-রাস্তাও পিছনে ফেলে একটা সরু রাস্তা ধরে একটা অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি অঞ্চলে এসে পড়লাম। আমরা। পরে জেনেছিলাম। এটার নাম প্যাটারসন স্ট্রিট। এখানেই একটা বত্ৰিশ তলা বাড়ির সাত তলায় পূর্ণেন্দুবাবুর ফ্ল্যাট।
গাড়ি থেকে যখন নামছি তখন আমাদের পাশ দিয়ে একটা কালো গাডি হঠাৎ স্পিড বাড়িয়ে বেরিয়ে গেল আর ফেলুদা কেমন যেন একটু টান হয়ে গেল। এই গাড়িটাকে আমি আগেও আমাদের পিছনে আসতে দেখেছি। এদিকে পূর্ণেন্দুবাবু নেমেই এগিয়ে গেছেন। কাজেই আমাদেরও তাঁকে অনুসরণ করতে হল।
একটু হাত পা ছড়িয়ে বসুন স্যার, আমাদের নিয়ে তাঁর বৈঠকখানায় ঢুকেই বললেন পূর্ণেন্দুবাবু। দুঃখের বিষয় আমার এক ভাগনের বিয়ে, তাই আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে এই সেদিন রেখে এসেছি কলকাতায়। আশা করি আতিথেয়তার একটু-আধটু ত্রুটি হলে মাইন্ড করবেন না। —কী খাবেন বলুন।
সবচেয়ে ভাল হয় চা হলে, বলল ফেলুদা।
টি-ব্যাগস-এ আপত্তি নেই তো?
মোটেই না।
ঘরের উত্তর দিকে একটা বড় ছড়ানো জানালা দিয়ে হংকং শহরের একটা অংশ দেখা যাচ্ছে। লালমোহনবাবু দৃশ্য দেখছেন, আমি দেখছি সোনি কালার টেলিভিশনের পাশে আরেকটা যন্ত্র, সেটা নিশ্চয়ই ভিডিয়ো। তারই পাশে তিন তাক ভরা ভিডিয়ো ফিল্ম। তার মধ্যে বেশির ভাগই হিন্দি, আর অন্য পাশে টেবিলের উপর ডাই করা ম্যাগাজিন। ফেলুদা তারই খানকতক টেনে নিয়ে পাতা ওলটাতে আরম্ভ করেছে। মিঃ পাল ঘরে নেই। তাই এই ফাঁকে প্রশ্নটা না করে পারলাম না।
গাড়িতে কে ছিল ফেলুদা?
যে না-থাকলে আমাদের আসা বৃথা হত।
বুঝেছি।
হীরালাল সোমানি।
কিন্তু লোকটা কী করে জানল যে আমরা এসেছি?
খুব সহজ, বলল ফেলুদা। আমরা যে ভাবে ওর আসার ব্যাপারটা জেনেছি সেই ভাবেই! প্যাসেঞ্জার লিস্ট চেক করেছে। এয়ারপোর্টে ছিল নিশ্চয়ই। ওখান থেকে পিছু নিয়েছে।
লালমোহনবাবু জানালা থেকে ফিরে এসে বললেন, ছবি যদি পাচার হয়ে গিয়ে থাকে তা হলে আর আমাদের পিছনে লাগার কারণটা কী?
সেটাই তো ভাবছি।
আসুন স্যার!
পূর্ণেন্দুবাবু ট্রে-তে চা নিয়ে এসেছেন, সঙ্গে বিলিতি বিস্কুট। টেবিলের উপর ট্রে-টা রেখে ফেলুদার দিকে ফিরে বললেন, আপনি যে ম্যান্ধাতার আমলের ফিল্মের পত্রিকায় মশগুল হয়ে পডালেন।
ফেলুদা একটা ছবি বেশ মন দিয়ে দেখতে দেখতে বলল, স্ক্রিন ওয়ার্লডের এই সংখ্যান্টা কি আপনার খুব কাজে লাগছে? এটা সেভেনটি-সিক্স-এর।
মোটেই না। আপনি স্বচ্ছন্দে নিতে পারেন। ওগুলো আমি দেখি না মশাই, দেখেন আমার গিন্নি। একেবারে ফিল্মের পোকা।
থ্যাঙ্ক ইউ। তোপ্সে, এই পত্রিকাটা আমার ব্যাগের মধ্যে ভরে দে তো। ইয়ে, আপনাদের এখানকার আপিসি-টাপিস খোলে কখন?
আর মিনিট দিশেকের মধ্যেই খুলে যাবে। আপনি সেই সাহেবকে ফোন করবেন তো?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
নম্বর আছে?
আছে।
ফেলুদা নোটবুক বার করল! —এই যে-৫-৩১,১৬৮৬।
হুঁ। হংকং-এর নম্বর। আপিসটা কোথায়?
হেনেসি স্ট্রিট। চোদ্দো নম্বর।
হুঁ। আপনি দশটায় ফোন করলেই পাবেন।
আমাদের হোটেল কোনটা ঠিক করেছেন জানতে পারি কি?
পার্ল হোটেল। এখান থেকে হেঁটে পাঁচ মিনিট। তাড়া কীসের? দুপুরের খাওয়াটা সেরে যাবেন এখন। কাছেই খুব ভাল ক্যান্টনিজ রেস্টোরান্ট আছে। তারপর, আপনাদের মিশন যদি আজ স্যাকসেসফুল হয়, তা হলে কাল নিয়ে যাব কাউলুনের এক রেস্টোরান্টে। এমন একটা জিনিস খাওয়াব যা কখনও খাননি।