সকালে উঠে জানালা দিয়ে চেয়ে দেখি আমরা সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে চলেছি। তারপর ক্রমে দেখা গেল জলের উপর উচিয়ে আছে কচ্ছপের খোলার মতো সব ছোট ছাট দ্বীপ। প্লেন নীচে নামছে বলে দ্বীপগুলো ক্ৰমে বড় হয়ে আসছে, আর বুঝতে পারছি তার অনেকগুলোই আসলে জলে-ডুবে-থাকা পাহাড়ের চূড়ো।
সেগুলোর উপর দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ দেখতে পেলাম পাহাড়ের ঘন সবুজের উপর সাদার ছোপ।
আরও কাছে আসতে সেগুলা হয়ে গেল পাহাড়ের গায়ে থরে থরে সাজানো রোদে-চোখ-ঝলসানো বিশাল বিশাল হাইরাইজ।
হংকং-এ ল্যান্ডিং করতে হলে পাইলটের যথেষ্ট কেরামতির দরকার হয় সেটা আগেই শুনেছি। তিনদিকে সমুদ্রের মাঝখানে এক চিলতে ল্যান্ডিং স্ট্রিপ—হিসেবে একটু গণ্ডগোল হলে জলে ঝপাং, আর বেশি গণ্ডগোল হলে সামনের পাহাড়ের সঙ্গে দড়াম্।
কিন্তু এ দুটোর কোনওটাই হল না। মোক্ষম হিসেবে প্লেন গিয়ে নামল ঠিক যেখানে নামবার, থামল যেখানে থামবার, আর তারপর উলটা মুখে গিয়ে টার্মিন্যাল বিল্ডিং-এর পাশে ঠিক এমন জায়গায় দাঁড়াল যে চাকার উপর দাঁড় করানো দুটো চারকোনা মুখ-ওয়ালা সুড়ঙ্গ এসে ইকনমি ক্লাস আর ফাস্ট ক্লাসের দুটো দরজার মুখে বেমালুম ফিট করে গেল। ফলে আমাদের আর সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে হল না, সোজা দরজা দিয়ে বেরিয়ে সুড়ঙ্গে ঢুকে টামিনাল বিল্ডিং-এর ভিতরে পৌঁছে গেলাম।
হংকং-এর জবাব নেই বললেন চোখ-ছানাবড়া লালমোহনবাবু।
এটা হংকং-এর একচেটে ব্যাপার নয় লালমোহনবাবু, বলল ফেলুদা।ভারতবর্ষের বাইরে পৃথিবীর সব বড় এয়ারপোর্টেই প্লেন থেকে সোজা টাৰ্মিনাল বিল্ডিং-এ ঢুকে যাবার এই ব্যবস্থা।
হংকং-এ এক মাসের কম থাকলে ভিসা লাগে না, কাস্টমস-এও বিশেষ কড়াকড়ি নেই,–তাই বিশ মিনিটের মধ্যে সব ল্যাঠা চুকে গেল। লাগোজ ছিল সামান্যই, তিন জনের তিনটে ছোট সুটকেস, আর কাঁধে একটা করে ছোট ব্যাগ। সব মাল আমাদের সঙ্গেই ছিল।
ফাস্টমস থেকে বেরিয়ে এসে দেখি একটা জায়গায় লোকের ভিড়, তাদের মধ্যে একজনের হাতে একটা হাতলের মাথায় বোর্ডে লেখা পি. মিটার। বুঝলাম ইনিই হচ্ছেন পূর্ণেন্দু পাল। পরস্পরের মুখ চেনা নেই বলে এই ব্যবস্থা।
ওয়েলকাম টু হংকং, বলে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন পাল মশাই। নবকুমারবাবুরই বয়স, অর্থাৎ চল্লিশ-বেয়াল্লিশ-এর মধ্যেই। মাথায় টাক পড়ে গেছে, তবে দিব্যি চকচকে স্মার্ট চেহারা, আর গায়ের খয়েরি সুন্টটাও স্মার্ট আর চকচকে। ভদ্রলোক যে রোজগার ভালই করেন, আর এখানে দিব্যি ফুর্তিতে আছেন, সেটা আর বলে দিতে হয় না।
একটা গাঢ় নীল জামান ওপেল গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। আমরা। ভদ্রলোক নিজেই ড্রাইভ করেন। ফেলুদা ওঁর পাশে সামনে বসল, আমরা দুজন পিছনে। আমাদের গাড়ি রওনা দিয়ে দিল!
এয়ারপোর্টটা কাউলূনে, বললেন মিঃ পাল। আমার বাসস্থান এবং দাকান দুটোই হংকং-এ। কাজেই আমাদের বে পেরিয়ে ওপারে যেতে হবে।
আপনার উপর এভাবে ভর করার জন্য সত্যিই লজ্জিত, বলল ফেলুদা।
ভদ্রলোক কথাটা উড়িয়েই দিলেন।
কী বলছেন মশাই। এটুকু করব না? এখানে একজন বাঙালির মুখ দেখতে পেলে কীরকম লাগে তা কী করে বলে বোঝাব? ভারতীয় গিজগিজ করছে। হংকং-এ, তবে বঙ্গসন্তান তো খুব বেশি নেই!
আমাদের হোটেলের কোনও ব্যবস্থা–?
হয়েছে, তবে আগে চলুন তো আমার ফ্ল্যাটে! ইয়ে, আপনি তো ডিটেকটিভ?
অজ্ঞে হ্যাঁ।
কোনও তদন্তের ব্যাপারে এসেছেন তো? হ্যাঁ।
একদিনের মামলা। কাল রাত্রেই আবার এয়ার ইন্ডিয়াতেই ফিরে যাব।
কী ব্যাপার বলুন তো।
নবকুমারবাবুদের বাড়ি থেকে একটি মহামূল্য পেন্টিং, চুরি হয়ে এখানে এসেছে। এনেছে সোমানি বলে এক ভদ্রলোক; হীরালাল সোমানি? সেটা চালান যাবে এক আর্মেনিয়নের হাতে। জিনিসটার দাম বেশ কয়েক লাখ টকা।
বলেন কী?
সেইটোকে উদ্ধার করতে হবে।
ওরে বাবা, এ তো ফিল্মের গপ্পো মশাই। তা এই আমেনিয়ানটি থাকেন কোথায়?
এঁর আপিসের ঠিকানা আছে আমার কাছে।
সোমানি কি কলকাতার লোক?
হ্যাঁ, এবং তিনি এসেছেন গত শনিবারের ফ্লাইটে। সে ছবি ইতিমধ্যে সাহেবের কাছে পৌঁছে গেছে।
সর্বনাশ! তা হলে?
তা হলেও সাহেবের সঙ্গে একবার দেখা করে ব্যাপারটা বলতে হবে। চোরাই মালি ঘরে রাখা তার পক্ষেও নিরাপদ নয়। সেইটে তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে।
হুঁ…
পূর্ণেন্দুবাবুকে বেশ চিন্তিত বলে মনে হল।
লালমোহনবাবুকে একটু গম্ভীর দেখে গলা বেশি না তুলে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার। হংকংকে কি বিলেত-বলা চলে? জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রলোক।
বললাম, তা কী করে বলবেন। বিলেত তো পশ্চিমে। এটা তো ফার ইস্ট। তবে বিলেতের যা ছবি দেখেছি তার সঙ্গে এর কোনও তফাত নেই।
ফেলুদার কান খাড়া, কথাগুলো শুনে ফেলেছে। বলল, আপনি চিন্তা করবেন না, লালমোহনবাবু। আপনার গড়পীরের বন্ধুদের বলবেন হংকংকে বলা হয় প্রাচ্যের লন্ডন। তাতেই ওঁরা যথেষ্ট ইমপ্রেস্ড হবেন।
প্রাচ্যের লন্ডন! গুড।
ভদ্রলোক প্রাচ্যের লন্ডন বলে বিড়বিড় করছেন, এমন সময় আমাদের গাড়িটা গোঁৎ খেয়ে একটা চওড়া টানেলের ভিতর ঢুকে গেল। সারবাঁধা হলদে বাতিতে সমস্ত টানেলের মধ্যে একটা কমলা আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। পূর্ণেন্দুঝাবু বললেন আমরা নাকি জলের তলা দিয়ে চলেছি। আমাদের মাথার উপর হংকং বন্দর। আমরা বেরোব একেবারে হংকং-এর আলোয়।
লালমোহনবাবু বললেন, এমন দুর্দান্ত শহর, তার নামটা এমন হুপিং কাশির মতো হল কেন?