অনেক ধন্যবাদ।
আর আমি পূর্ণেন্দুকে কাল একটা টেলিগ্রাম করে দেব। আপনি যদি যান তা হলে ফ্লাইট নাম্বার জানিয়ে এই ঠিকানায় ওকে একটা তার করে দেবেন। ব্যস, আর কিছু ভাবতে হবে না।
খাম ছিল পাঁচ হাজার টাকার একটা চেক।
জলি-রুদ্রশেখরকে খোঁজার কী করবেন? ফেরার পথে লালমোহনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
ওঁর পাত্তা পাবার আশা কম, যদি বা ভদ্রলোক হংকং গিয়ে থাকেন।
গেছে কি না-গেছে সেটা জানছেন কী করে?
জানার কোনও উপায় নেই। তাকে দেশের বাইরে যেতে হলে তার নিজের নামে যেতে হবে; তার পাসপোর্টও হবে নিজের নামে। নবকুমারবাবুর বাবাকে যে পাসপোর্ট দেখিয়েছিলেন ভদ্রলোক, সেটা জাল ছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ক্ষীণদৃষ্টি বৃদ্ধের পক্ষে সেটা ধরার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু এয়ারপোর্টে তো আর সে ধাপ্পা চলবে না তার আসল নামটা যখন আমরা জানি না, তখন প্যাসেঞ্জার লিস্ট দেখে কোনও লাভ নেই।
তা হলে?
একটা ব্যাপার হতে পারে। আমার মনে হয়। সেই আর্মেনিয়ান ভদ্রলোকের নাম ঠিকানা নিতে জাল-রুদ্রশেখরকে একবার হীরালাল সোমানির কাছে যেতেই হবে। সোমানি সম্বন্ধে যা শুনলাম, এবং তাকে যতটুকু দেখেছি, তাতে মনে হয় না। সে নাম ঠিকানা দেবে। এত বড় দও সে হাতছাড়া করবে না। ছলেবলে কৌশলে সে জাল-রুদ্রশেখরের হাত থেকে ছবিটা আদায় করবে। তারপর সেটা নিয়ে নিজেই হংকং যাবে সাহেবকে দিতে।
তা হলে তো সোমানির নাম খুঁজতে হবে প্যাসেঞ্জার লিস্টে।
তা তো বটেই। ওটার উপরই তো নির্ভর করছে আমাদের যাওয়া না-যাওয়া। লালমোহনবাবুর চট্ট করে চোখ কপালে তোলা থেকে বুঝলাম উনি একটা কুইক প্রার্থনা সেরে নিলেন যাতে হংকং যাওয়া হয়। যদি যাওয়া হয় তা হলে চিনে ভাষা শেখার প্রয়োজন হবে কি না জিজ্ঞেস করাতে ফেলুদা বলল, চিনে ভাষায় অক্ষর কটা আছে জানেন?
কটা?
দশ হাজার। আর আপনার জিভে প্লাস্টিক সার্জারি না করলে চিনে উচ্চারণ বেরোবে না। মুখ দিয়ে। বুঝেছেন?
বুঝলাম।
পরদিন সকালে আপিস খোলার টাইম থেকেই ফেলুদা কাজে লেগে গেল।
আজকাল শুধু এয়ার ইন্ডিয়া আর থাই এয়ারওয়েজে হংকং যাওয়া যায় কলকাতা থেকে। এয়ার ইন্ডিয়া যায় সপ্তাহে এক’দিন~—মঙ্গলবার, আর থাই এয়ারওয়েজ যায় সপ্তাহে তিনদিন–সোম, বুধ আর শনি—কিন্তু শুধু ব্যাঙ্কক পর্যন্ত; সেখান থেকে অন্য প্লেন নিতে হয়।
আজ শনিবার, তাই ফেলুদা প্রথমে থাই এয়ারওয়েজেই ফোন করল।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই প্যাসেঞ্জার লিস্টের খবর জানা গেল।
আজই সকালে হীরালাল সোমানি হংকং চলে গেছেন।
আমরা সবচেয়ে তাড়াতাড়ি যেতে পারি আগামী মঙ্গলবার, অর্থাৎ তরশু।
তার মানে হংকং-এ তিনটে দিন হাতে পেয়ে যাচ্ছে হীরালাল সোমানি।
সুতরাং ধরে নেওয়া যেতে পারে আমরা যতদিনে পৌঁছাব ততদিনে ছবি সোমানির হাত থেকে সাহেবের হতে চলে যাবে।
তা হলে আমাদের গিয়ে কোনও লাভ আছে কি?
কথাগুলো অবিশ্যি ফেলুদাই বলছিল আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে।
লালমোহনবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন—
টিনটোরেটোর ইটালিয়ান উচ্চারণটা কী মশাই?
তিনতোরোত্তো, বলল ফেলুদা।
নামের গোড়াতেই যখন তিন, আর আমি যখন আছি আপনাদের সঙ্গে, তখন মিশন সাকসেসফুল না হয়ে যায় না। –
যাবার ইচ্ছেটা আমারও ছিল পুরোমাত্রায়, বলল ফেলুদা, কিন্তু যাবার এত বড় একটা জাস্টিফিকেশন খুঁজে পাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হত না।
১০. আমাদের হংকং যাওয়া
মঙ্গলবার ১২ই অক্টোবর রাত দশটায়। এয়ার ইন্ডিয়ার ৩১৬নম্বর ফ্লাইটে আমাদের হংকং যাওয়া। বোইং ৭০৭ আর ৭৩৭-এ ওডার অভিজ্ঞতা ছিল এর আগে, এবার ৭৪৭ জাম্বো-জেটে চড়ে আগের সব ওড়াগুলো ছেলেমানুষি বলে মনে হল।
প্লেনের কাছে পৌঁছে বিশ্বাস হচ্ছিল না যে এত বড় জিনিসটা আকাশে উড়তে পারে। সিড়ি দিয়ে উঠে ভিতরে যাত্রীর ভিড দেখে সেটা আরও বেশি করে মনে হল। লালমোহনবাবু যে বলেছিলেন শুধু ইকনমি ক্লাসের যাত্রীতেই নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম ভরে যাবে, সেটা অবিশ্যি বাড়াবাড়ি, কিন্তু একটা মাঝারি সাইজের সিনেমা হলের একতলাটা যে ভরে যাবে তাতে সন্দেহ নেই।
ফেলুদা গতকাল সকালেই পূর্ণেন্দুবাবুকে টেলিগ্রাম করে দিয়েছে। আমরা হংকং পৌঁছাব আগামীকাল সকাল পৌনে আটটা হংকং টাইম—তার মানে ভারতবর্ষের চেয়ে আড়াই ঘণ্টা এগিয়ে।
যেখানে যাচ্ছি সেটা যদি নতুন জায়গা হয় তা হলে সেটা সম্বন্ধে পড়াশুনা করে নেওয়াটা ফেলুদার অভ্যাস, তাই ও গতকালই অক্সফোর্ড বুক অ্যান্ড স্টেশনারি থেকে হংকং সম্বন্ধে একটা বই কিনে নিয়েছে। আমি সেটা উলটে পালটে ছবিগুলো দেখে বুঝেছি হংকং-এর মতো এমন জমজমাট রংদার শহর খুব কমই আছে। লালমোহনবাবু উৎসাহে ফেটে পড়ছেন ঠিকই, কিন্তু যেখানে যাচ্ছেন সে-জায়গা সম্বন্ধে ধারণা এখনও মোটেই স্পষ্টই নয়। একবার জিজ্ঞেস করলেন চিনের প্রাচীরটা দেখে আসার কোনও সুযোগ হবে কি না। তাতে ফেলুদাকে বলতে হল যে চিনের প্রাচীর হচ্ছে পিপলস রিপাবলিক অফ চায়নায়, পিকিং-এর কাছে, আর হংকং হল ব্রিটিশদের শহর। পিকিং হংকং থেকে অন্তত পাঁচশো মাইল।
আবহাওয়া ভাল থাকলে জাম্বো জেটের মতো এমন মোলায়েম ঝাঁকানিশূন্য ওড়া আর কোনও প্লেনে হয় না। মাঝরাত্রে ব্যাঙ্ককে নামে প্লেনটা, কিন্তু যাত্রীদের এয়ারপোর্টে নামতে দেবে না শুনে দিব্যি ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম।