সেটা বলতে আমি বাধ্য। নই।
তা হলে আমিও ইনফরমেশন দিতে বাধ্য নই।
এবার দেবেন কি?
রুদ্রশেখর বিদ্যুদ্বেগে উঠে দাঁড়িয়েছে, তার হাতে একটা একটি রিভলভার, সোজা। হীরালালের দিকে তাগ করা।
বলুন মিঃ সোমানি। আমার জানা দরকার। আমি আজই সে লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাই।
টেবিলের তলায় সোমানি যে তাঁর বাঁ হাঁটু দিয়ে একটি বোতামে চাপ দিয়েছেন, এবং দেওয়ামাত্র রুদ্রশেখরের পিছনের একটি ঘরের দরজা খুলে গিয়ে দুটি লোক বেরিয়ে এসে তাঁর পিছনে দাঁড়িয়েছে, সেটা তাঁর জানার উপায় ছিল না।
পরমুহূর্তেই রুদ্রশেখর দেখলেন যে তিনি মোক্ষম প্যাঁচে পড়েছেন।
একটি লোক তার ডান হাতটা ধরে তাতে মোচড় দেওয়াতে রিভলভারটা এখন তারই হাতে চলে গেছে, এবং সেটি এখন রুদ্রশেখরের দিকেই তাগ করা।
পালাবার কোনও চেষ্টায় ফল হবে না। মিঃ নিয়োগী। এই দুজন লোক আপনার সঙ্গে গিয়ে আপনার কাছ থেকে ছবিটা নিয়ে আসবে। আশা করি আপনি মূখের মতো বাধা দেবেন না।
বিশ মিনিটের মধ্যে লোক দুজন সমেত রুদ্রশেখর একটি ফিয়াট গাড়িতে করে সদর স্ট্রিটের একটি হোটেলে পৌঁছে গেলেন। আপাতদৃষ্টিতে কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়—দুটি লোককে সঙ্গে নিয়ে রুদ্রশেখর তাঁর ঘরে চলেছেন। দুজনের একজনের হাত কোটের পকেটে ঠিকই, কিন্তু সে হাতে যে রিভলভার ধরা সেটা বাইরের লোকে বুঝবে কী করে?
উনিশ নম্বর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেবার পর রিভলভার বেরিয়ে এল কোটের পকেট থেকে। রুদ্রশেখর বুঝলেন কোনও আশা নেই, তাঁকে আদেশ মানতেই হবে।
সুটকেস বিছানার উপর রেখে চাবি দিয়ে ডালা খুলে একটা শবরের কাগজে মোড়া পাতলা বোর্ড বার করে আনেন রুদ্রশেখর।
যে লোকটির হাতে রিভলভার নেই। সে মোড়কটা ছিনিয়ে নিয়ে খবরের কাগজের র্যাপিং খুলতেই বেরিয়ে পড়ল যীশু খ্রিষ্টের ছবি।
লোকটা ছবিটা আরার কাগজে মুড়ে পকেট থেকে প্রথমে একটি সিস্কের রুমাল বার করে তাই দিয়ে রুদ্রশেখরের মুখ বাঁধল।
তারপর একটি মেক্ষম ঘুষিতে তাকে অজ্ঞান করে মেঝেতে ফেলে, নাইলনের দড়ির সাহায্যে আষ্ট্রেপৃষ্ঠে বেঁধে সেইভাবেই ফেলে রেখে দুজনে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
পনেরো মিনিটের মধ্যে যীশু খ্রিষ্টের ছবি হীরালাল সোমানির কাছে পৌঁছে গেল। সোমানি ছবিটার উপর চোখ বুলিয়ে দুটির একটি লোকের হাতে দিয়ে বললেন, এটা ভাল করে প্যাক করো।
তারপর অন্য লোকটিকে বললেন, একটা জরুরি টেলিগ্রাম লিখে দিচ্ছি। এখুনি পার্ক স্ট্রিট পোস্টাপিসে চলে যাও। টেলিগ্রাম আজকের মধ্যেই যাওয়া চাই।
সোমানি টেলিগ্রাম লিখলেন–
মিঃ ওয়ালটার ক্রিকোরিয়ান
ক্রিকোরিয়ান এন্টারপ্রাইজেজ
১৪ হেনেসি স্ট্রিট
হংকং
অ্যারাইভিং স্যাটারডে নাইনথ অক্টোবর
–সোমানি।
০৯. ইন্সপেক্টর মহাদেব মণ্ডল
সন্ধের দিকে ইন্সপেক্টর মণ্ডল এলেন। মহাদেব মণ্ডল। নামটা শুনলেই যে একটা গোলগাল নাদুসনুদুস চেহারা মনে হয়, মোটেই সেরকম নয়। বরং একেবারেই উলটো। লালমোহনবাবু পরে বলেছিলেন, নামের তিনভাগের দুভাগই যখন রোগা, তখন এটাই স্বাভাবিক, যদিও সচরাচর এটা হয় না। এখানে অবিশ্যি নাম বলতে লালমোহনবাবু দারোগা বোঝাতে চেয়েছিলেন।
দেখলাম ফেলুদার নাম যথেষ্ট জানা আছে ভদ্রলোকের।
আপনি তো খড়গপুরের সেই জোড়া খুনের রহস্যটা সমাধান করেছিলেন, তাই না? সেভেনটি এইটে?
যমজ ভাইয়ের একজনকে মারার কথা, কোনও রিস্ক না নিয়ে দুজনকেই খুন করেছিল এক ভাড়াটে গুণ্ডা। ফেলুদার খুব নামডাক হয়েছিল কেসটাতে।
ফেলুদা বলল, বর্তমান খুনের ব্যাপারটা কী বুঝেছেন?
খুনি তো যিনি ভেগেছেন তিনিই বললেন ইন্সপেক্টর মণ্ডল। এ বিষয়ে তো কোনও ডাউট নেই, কিন্তু কথাটা হচ্ছে মোটিভ নিয়ে।
একটা মহামূল্য জিনিস নিয়ে খুনি ভেগেছেন সেটা জানেন কি?
এটা আবার কী ব্যাপার?
এটা আবিষ্কারের ব্যাপারে আমার সামান্য অবদান আছে।
জিনিসটা কী?
একটা ছবি! স্টুডিয়োতেই ছিল। সেই ছবিটা নেবার সময় বঙ্কিমবাবু গিয়ে পড়লে পরে খুনটা অসম্ভব নয়।
তা তো বটেই।
আপনি সাংবাদিক ভদ্রলোকটিকে জেরা করেছেন?
করেছি বইকী। সত্যি বলতে কী, দু-দুটি সম্পূর্ণ অচেনা লোক একই সঙ্গে বাড়িতে এসে রয়েছে এটা খুবই খটকার ব্যাপার। ওঁর ওপরেও যে আমার সন্দেহ পড়েনি তা না, তবে জেরা করে মনে হল লোকটি বেশ স্ট্রেট-ফরওয়ার্ড, কথাবাতাও পরিষ্কার। তা ছাড়া, যে মূর্তিটা মাথায় মেরে খুন করা হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস, তাতে স্পষ্ট আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। তার সঙ্গে এনার আঙুলের ছাপ মেলে না।
রুদ্রশেখরবাবুর ট্যাক্সির খোঁজটা করেছেন? ডরু বি টি ফোর ওয়ান ডবল টু?
বা-বা, আপনার তো খুব মেমরি!—খোঁজ করা হয়েছে বই কী। পাওয়া গেছে সে ট্যাক্সি; রুদ্রশেখরকে এখান থেকে নিয়ে গিয়ে সদর স্ট্রিটে একটা হোটেলে নামায়। সে হোটেলে খোঁজ করে ভদ্রলোককে পাওয়া যায়নি। অন্য হোটেলগুলোতেও নাম এবং চেহারার বর্ণনা দিয়ে খোঁজ করা হচ্ছে, কিন্তু এখনও কোনও খবর আসেনি। মহামূল্য ছবি যদি নিয়ে থাকে তা হলে তো সেটাকে বিক্রি করতে হবে। সে কাজটা কলকাতায় হবারই সম্ভাবনা বেশি।
সে ব্যাপারে পুরোপুরি ভরসা করা যায় বলে মনে হয় না।
আপনি বলছেন শহর ছেড়ে চলে যেতে পারে?
দেশ ছেড়েও যেতে পারে।
বলেন কী?
আমার যদ্দুর ধারণা আজই হংকং-এ একটা ফ্লাইট আছে।