বিছানা করা হয়নি দেখছি, বলল ফেলুদা। সত্যি, মশারিটা পর্যন্ত এখনও ঝুলে রয়েছে।
সকাল থেকেই বাড়িতে যা হট্টগোল, চাকরব্যাকররা সব কাজকর্ম ভুলে গেছে আর কী
পাশের ঘরটিায় কে থাকে?
ওটায় থাকতেন। বঙ্কিমবাবু।
দুটো ঘরের মাঝখানে একটা দরজা রয়েছে, কিন্তু সেটা বন্ধ। ফেলুদা রুদ্রশেখরের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাইরের দরজা দিয়ে ঢুকাল বঙ্কিমবাবুর ঘরে।
এঘরে স্বভাবতই জিনিসপত্র অনেক বেশি। আলনায় জামা-কাপড়, তার নীচে চট-জুতো, টেবিলের উপর কিছু বই, কলপি, প্যাড়, একটা রেমিংটন টাইপরাইটার। দেয়ালে টাঙানো কিছু ফোটাগ্রাফ, তার মধ্যে একটা একজন সন্ন্যাসী-গোছের ভদ্রলোকের; এ ঘরেও বিছানা করা হয়নি। মশারি ঝুলে রয়েছে।
ফেলুদা হঠাৎ খাটের দিকে এগিয়ে গিয়ে মশারিটা তুলে ধরল, তার দৃষ্টি বালিশের দিকে।
বালিশটা তুলতেই তার তলা থেকে একটা জিনিস বেরিয়ে পড়ল।
একটা ছোট্ট নীল বাক্সের মধ্যে একটা ট্র্যাভেলিং অ্যালাম ক্লিক।
এ জিনিস তো আমরাও এককালে করতুম মশাই বললেন লালমোহনবাবু। আমার পাশের ঘরে ছোটকাকা শুতেন; পরীক্ষার সময় অ্যালার্ম দিয়ে ভোরে উঠাতুম, আর ওঁর যাতে ঘুম না ভাঙে তাই ঘড়িটা রাখতুম, বালিশের নীচে।
হুঁ, বলল ফেলুদা, কিন্তু ইনি অ্যালার্ম দিয়েছিলেন সাড়ে তিনটেয়।
সাড়ে তিনটে!।
নবকুমারবাবু অবাক।
এবং সেই সময়ই বোধহয় গিয়েছিলেন চন্দ্ৰশেখরের স্টুডিয়োতে। মনে হয় ভয়ানক কিছু একটা সন্দেহ করছিলেন। সেই সন্দেহের কথাটাই বোধহয় আমায় বলতে চেয়েছিলেন গতবার।
*
এই খুনের আবহাওয়াতেও লালমোহনবাবুরু হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে ওঠার কারণ আর কিছুই না; নবকুমারবাবুর এগারো বছরের ছেলে আর ন বছরের মেয়ে দুজনেই বেরিয়ে গেল জটায়ুর অন্ধ ভক্ত। ভদ্রলোককে বৈঠকখানার সোফায় ফেলে দুজনেই চেপে ধরল-একটা। গল্প বলুন! একটা গল্প বলুন!
লালমোহনবাবু খুব স্পিড়ে উপন্যাস লেখেন ঠিকই, তাই বলে কেউ চেপে ধরলেই যে টুথপেস্টের টিউবের মতো গলগল করে নতুন গল্প বেরিয়ে যাবে এমন নয়।আচ্ছা বলছি বলে পর পর তিনবার খানিকদূর এগোতেই ভাই বোনে চেঁচিয়ে ওঠে—আরে, এ তোসাহারায় শিহরন আরে, এ তো হন ডুরাসে হাহাকার এ তো অমুক, এ তো তমুক…
শেষে ভদ্রলোকের কী অবস্থা হল জানি না, কারণ ফেলুদা নবকুমারবাবুকে বলল যে একবার খুনের জায়গাটা দেখবে।
লালমোহনবাবুকে দোতলায় রেখে আমরা তিনজনে গেলাম চন্দ্ৰশেখরের স্টুড়িয়োতে।
প্রথমেই যেটার দিকে দৃষ্টি দিয়ে ফেলুদা থেমে গেল সেটা হল ঘরের মাঝখানের টেবিলটা।
এর ওপর একটা ব্ৰঞ্জের মূর্তি ছিল না—একটা ঘোড়সওয়ার?
ঠিক বলেছেন। ওটা ইন্সপেক্টর মণ্ডল নিয়ে গেলেন আঙুলের ছাপ নেওয়ার জন্য। ওঁর ধারণা ওটা দিয়েই খুনটা করা হয়েছে।
হুঁ।
এবার আমরা তিনজনেই দক্ষিণের দেয়ালের কোণের ছবিটার দিকে এগিয়ে গেলাম।
আজ যেন যীশুর জৌলুস আরও বেড়েছে। কেউ পরিষ্কার করেছে কি ছবিটাকে?
ফেলুদা এক পা এক পা করে এগিয়ে গিয়ে ছবিটার একেবারে কাছে দাঁড়াল। তারপর মিনিটখানেক সেটার দিকে চেয়ে থেকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করল।
ইটালিতে রেনেসাঁসের যুগে মিনি-শ্যামাপোকা ছিল কি?
মিনি-শ্যামপোকা? নবকুমারবাবুর চোখ কপালে উঠে গেছে।
আজকাল তিনরকম শ্যামাপোকা হয়েছে জানেন তো? মিনি, মিডি আর ম্যাক্সি। ম্যাক্সিগুলো সাদা, সবুজ নয়। মিনিগুলো রেগুলার কামড়ায়। সবুজ মিডিগুলো অবিশ্যি চিরকালই ছিল। কিন্তু ষড়বিংশ শতাব্দীর ভেনিসে ছিল কি না সে বিষয় আমার সন্দেহ আছে।
ভেনিসে না হাক, এই বৈকুণ্ঠপুরে তো আছেই। কাল রাত্রেও হয়েছিল।
তা হলে দুটো প্রশ্ন করতে হয়, বলল ফেলুদা, প্রাচীন পেন্টিং-এর শুকনা রঙে সে পোকা আটকায় কী করে, আর যে ঘরে বাতি জ্বলে না সে ঘরে পোকা আসে কী করে।
তার মানে–?
তার মানে এ ছবি আসল নয়, মিস্টার নিয়োগী। আসল ছবিতে যীশুরু কপালে শ্যামপোকা ছিল না, আর ছবির রংও এত উজ্জ্বল ছিল না। এ ছবি গত দু-এক দিনে আঁকা হয়েছে মূল থেকে কপি করে। কাজটা রাত্তিরে মামবাতি বা কেরোসিনের বাতি জ্বলিয়ে হয়েছে, আর সেই সময় একটি শ্যামপোকা ঢুকে যীশুর কপালের কাঁচা রঙে আটকে গেছে।
নবকুমারবাবুর মুখ ফ্যাকাসে।
তা হলে আসল ছবি–?
আসল ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে মিস্টার নিয়োগী। খুব সম্ভবত আজ ভোরেই। এবং কে সরিয়েছে সেটা তো নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।
০৮. রুদ্রশেখরের কথা (২)
গুড আফটারনুন, মিস্টার নিয়োগী।
গুড আফটারনুন।
রুদ্রশেখর এগিয়ে এসে সোমানির বিপরীত দিকে একটা চেয়ারে বসলেন। দুজনের মাঝখানে একটা প্রশস্ত আধুনিক ডেস্ক। আপিসঘরটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ও চারিদিক থেকে বন্ধ। তাই শহরের কোনও শব্দই এখানে পৌঁছায় না। পাশের শেলফের উপর ঘড়িটা ইলেকট্রনিক, তাই সেটাও নিঃশব্দ।
আপনি কি ছবিটা পেয়েছেন? প্রশ্ন করলেন। হীরালাল সোমানি।
রুদ্রশেখর নিয়োগী কোনও জবাব দেওয়ার পরিবর্তে বললেন, আপনি তো আরেকজনের হয়ে ছবিটা কিনতে চান, তাই না?
হীরালাল একদৃষ্ট্রে চেয়ে রইলেন রুদ্রশেখরের দিকে, ভাবটা যেন তিনি প্রশ্নটা শুনতেই পাননি।
আমি সেই ভদ্রলোকের নাম-ঠিকনাটা চাইতে এসেছি, বললেন রুদ্রশেখর নিয়োগী।
হীরালাল ঠিক সেই ভাবেই চেয়ে থেকে বললেন, আমি আবার জিজ্ঞেস করছি মিঃ নিয়োগী-ছবিটা কি এখন আপনার হাতে?