ফেলুদা–আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন কি?
ভূদেব–মাঝে মাঝে একটা করে পোস্টকার্ড লিখত, তবে
অনেক’দিন আর খবর পাইনি। ফেলুদা-শেষ কবে পেয়েছিলেন মনে আছে?
ভূদেব-দাঁড়াও, এই বাক্সের মধ্যেই আছে তার চিঠিগুলো। হ্যাঁ, সেপ্টেম্বর ১৯৭৭। হৃষীকেশ থেকে লিখেছে এটা।
ফেলুদা—অর্থাৎ পাঁচ বছর আগে। তার মানে তো আইনের চোখে তিনি এখনও জীবিত!
ভূদেব–সত্যিই তো! এটা তো আমার খেয়াল হয়নি।
ফেলুদা–তার মানে রুদ্রশেখর এখনও তার সম্পত্তি ক্লেম করতে পারেন না।
পরদিন ভূদেব সিং গাড়িতে ঘুরিয়ে ভগওয়ানগড়ের যা কিছু দ্রষ্টব্য সব দেখিয়ে দিলেন। আমাদের। গড়ের ভগ্নস্তূপ, ভবানীর মন্দির, লক্ষ্মীনারায়ণ গার্ডেনস, পিথেরি লেক, জঙ্গলে হরিণের পাল–কিছুই বাদ গেল না।
কথাই ছিল এবার শেভরোলে গাড়ি আমাদের একেবারে নাগপুর অবধি পৌঁছে দেবে, যাতে আমাদের আর প্যাসেঞ্জার ট্রেনের ঝক্কি পোয়াতে না হয়। গাড়িতে ওঠার আগে ভূদেব সিং ফেলুদার কাঁধে হাত রেখে বললেন——
সি দ্যাট দ্য টিনটোরেটা ডািজনট ফল ইনটু দ্য রং হ্যান্ডস।
মি. নাগপালকে আগেই বলা ছিল; তিনি ওই আর্মেনিয়ান ভদ্রলোকের নাম ঠিকানা একটা কাগজে লিখে ফেলুদাকে দিলেন, ফেলুদা সেটা সযত্নে ব্যাগে পুরে রাখল।
পরদিন এগারোটায় বাড়ি ফিরে এক ঘণ্টার মধ্যে বৈকুণ্ঠপুর থেকে নবকুমারবাবুর টেলিফোন এল।
চট করে চলে আসুন মশাই। এখানে গণ্ডগোল ।
০৭. ছবিটা কি লোপাট হয়ে গেল
আমরা আধা ঘণ্টার মধ্যেই বেরিয়ে পড়লাম।
ছবিটা কি লোপাট হয়ে গেল নাকি মশাই? যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলেন লালমোহনবাবু।
সেইটেই তো ভয় পাচ্ছি।
অ্যাদ্দিন ছবির ব্যাপারটায় ঠিক ইন্টারেস্ট পাচ্ছিলুম না, জানেন। এখন বইটা পড়ে, আর ভূদেব রাজার সঙ্গে কথা বলে কেমন যেন একটা নাড়ীর যোগ অনুভব করছি। ওই টিরিনটোরোর সঙ্গে।
ফেলুদা গম্ভীর, লালমোহনবাবুর ভুল শুধরোনোর চেষ্টাও করল না।
এবারে হরিপদবাবু স্পিডোমিটারের কাঁটা আরও চড়িয়ে রাখায় আমরা ঠিক দুঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম।
নিয়োগীবাড়িতে এই তিনদিনে যেমন কিছু নতুন লোক এসেছে-নবকুমারবাবুর স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে-তেমনি কিছু লোক চলেও গেছে।
চন্দ্ৰশেখরের ছেলে রুদ্রশেখর আজ ভোরে চলে গেছেন কলকাতা।
আর বঙ্কিমবাবুও নেই।
বঙ্কিমবাবু খুন হয়েছেন।
কোনও ভারী জিনিস দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করা হয়, আর তার ফলেই তাঁর মৃত্যু হয়। বেশ বেলা পর্যন্ত তাঁর কোনও হদিস না পেয়ে খোঁজাখুঁজি পড়ে যায়। শেষে চাকর গোবিন্দ স্টুডিয়োতে গিয়ে দেখে তাঁর মৃতদেহ পড়ে আছে মেঝেতে, মাথার চার পাশে রক্ত। পুলিশের ডাক্তার দেখে বলেছে মৃত্যু হয়েছে আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে। সময়-আন্দাজ রাত তিনটে থেকে ভোর পাঁচটার মধ্যে।
নবকুমার বললেন, আপনাকে ফোনে পাওয়া গেল না, তাই বাধ্য হয়েই পুলিশে খবর দিতে হল।
তা ভালই করেছেন, বলল ফেলুদা-কিন্তু কথা হচ্ছে-ছবিটা আছে কি?
সেটাই তো আশ্চর্য ব্যাপার মশাই। আততায়ী যে কে সেটা আন্দাজ করা তো খুব মুশকিল নয়; ভদ্রলোকের হাবভাব এমনিতেই সন্দেহজনক মনে হত। বোঝাই যাচ্ছিল টাকার দরকার, অথচ আইনের পথে যেতে গেলে সম্পত্তি পেতে অন্তত ছ-সাত মাস তো লাগতই–
আরও অনেক বেশি, বলল ফেলুদা, পাঁচ বছর আগেও ভূদেব সিং চন্দ্ৰশেখরের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছেন।
তাই বুঝি? তা হলে তো ভদ্রলোকের কোনও লিগ্যাল রাইটই ছিল না।
তাতে অবিশ্যি চুরি করতে কোনও বাধা নেই।
কিন্তু চুরি হয়নি। ছবি যেখানে ছিল সেখানেই আছে।
তাজ্জব ব্যাপার, বলল ফেলুদা।এ জাতীয় ঘটনা সমস্ত হিসেবা-টিসেব গুলিয়ে দেয়। পুলিশে কী বলে?
এক দফা জেরা হয়ে গেছে। সকালেই। আসল কাজ তো হল, যে চলে গেছে তাকে খুঁজে পাওয়া; কারণ, কাল রাত্রে এ বাড়িতে ছিলাম। আমি, আমার স্ত্রী আর ছেলেমেয়ে, বাবা, মা, রবীনবাবু আর চাকর-বাকর।
রবীনবাবু, ভদ্রলোকটি–?
উনি প্রায় রোজ রাত দেড়টা-দুটো অবধি ওঁর ঘবে কাজ করেন। চাকরেরা ওঁর ঘরে বাতি জুলতে দেখেছে। তাই সকল আটটার আগে বড় একটা ঘুম থেকে ওঠেন না। আটটায় ওঁর ঘরে চা দেয় গোবিন্দ। আজও দিয়েছে। রুদ্রশেখরও যে খুব সকলে উঠতেন তা নয়, তবে আজ সাড়ে ছাঁটার মধ্যে উনি চলে গেছেন। উনি আর ওঁর সঙ্গে একজন আর্টিস্ট।
আর্টিস্ট?
আপনি যেদিন গেলেন সেদিনই এসেছেন কলকাতা থেকে। রুদ্রশেখরই গিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। স্টুডিয়োর জিনিসপত্রের একটা ভালুয়েশন করার জন্য। সব বিক্রি করে দেবেন বলে ভাবছিলেন বোধহয়।
ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করে যাননি?
উঁহু। আমি তো জানি কলকাতায় যাচ্ছেন উকিল-টুকিলের সঙ্গে কথা বলতে; কাজ হলেই আবার ফিরে আসবেন। কিন্তু এখন তো আর মনে হয় না ফিরবেন বলে।
আমরা এক তলার বৈঠকখানায় বসে কথা বলছিলাম। নবকুমারবাবু বোধহয় আমাদের দোতলায় নিয়ে যাবেন বলে সোফা ছেড়ে উঠতেই ফেলুদা বলল—
রুদ্রশেখর যে ঘরটায় থাকতেন সেটা একবার দেখতে পারি কি?
নিশ্চয়ই। এই তো পাশেই।
ঘরের দক্ষিণ দিকের দরজা একটা দিয়ে আমরা মেঝেতে চিনে মাটির টুকরো বসানো একটা শোবার ঘরে ঢুকলাম। ঢুকেই মনে হল যেন উনবিংশ শতাব্দীতে এসে পড়েছি। এমন খাট, খাটের উপর মশারি টাঙানোর এমন ব্যবস্থা, এমন ড্রেসিং টেবিল, এমন রাইটিং ডেস্ক, কাপড় রাখার এমন অলিনা-কেনিওটাই আর আজকের দিনে দেখা যায় না। নবকুমারবাবু বললেন, এ ঘরটাতে আগে চন্দ্ৰশেখরের ভাই সূর্যশেখর।–অর্থাৎ নবকুমারবাবুর ঠাকুরদা—থাকতেন! ঠাকুরদাদা শেষের দিকে আর দোতলায় উঠতে পারতেন না। অথচ রোজ সকালে-বিকেলে মন্দিরে যাওয়া চাই, তাই একতলাতেই বসবাস করতেন।