এখানে কেউ মরতে আসে না রে ফটকে, বলল হারুন,–এখানে আসে বাঁচতে। ও-ও বেঁচে যাবে। ও যা করছে, সেটা স্রেফ অভ্যাসের ব্যাপার। অভ্যাসে কী যে হয়, সেটা খালিফ হারুনের খেলা দেখলে বুঝবি।
হারুন ওকে নিয়ে গেল ভিড়ের মধ্য দিয়ে, যেখানে ও আগে খেলা দেখাত, সেই জায়গায়। সেখানে এখন একটা মেয়ে খেলা দেখাচ্ছে। দড়ির উপর ব্যালান্সের খেলা। মাটি থেকে প্রায় সাত-আট হাত উঁচুতে টান করে বাঁধা দড়ির উপর দিয়ে দিব্যি এ-মাথা থেকে ও-মাথা চলে যাচ্ছে মেয়েটা। মাদ্রাজের মেয়ে, বলল হারুনদা।
আর একটা জায়গায় একটা শূন্যে ঝোলানো লোহার রিং-এর গায়ে আট-দশটা জায়গায় আগুন জ্বলছে দেখে ফটিক হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে উঠল, ওর ভিতর দিয়ে একটা লোক লাফাবে বুঝি?
হারুন হাঁটা থামিয়ে ওর দিকে দেখল। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোর মনে পড়ে গেছে? তুই আগে দেখেছিস এ জিনিস?
ফটিক হ্যাঁ বলতে গিয়েও পারল না। একটা আলো বাজনা-ভিড় মেশানো ছবি এক মুহূর্তের জন্য ওর চোখের সামনে ভেসে উঠে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে গেছে। এখন শুধু সামনে যা দেখতে পাচ্ছে, তাই।
হারুন আবার এগিয়ে গেল, ফটিক তার পিছনে।
যে জায়গাটায় হারুন খেলা দেখাবে, সেখানে এখন কেউ নেই। ডান দিকে একটা ভিড়ের পিছন থেকে ডুগডুগির শব্দ আসছে, ফটিক মানুষের পায়ের ফাঁক দিয়ে ভাল্লুকের কালো লোম দেখতে পেয়েছে। ডুগডুগি আর ঢোলক এখানে সব খেলাতেই বাজায়, কিন্তু হারুন থলি থেকে যেটা বার করল, সেটা ও দুটোর একটাও নয়। সেটা একটা বাঁশি; যেটার পিছন দিকটা সরু আর সামনের দিকটা চওড়া আর ফুল কাটা। সাতবার পর পর ফুঁ দিল বাঁশিটায় হারুনদা। ফটিক জানে যে, সব শব্দ ছাপিয়ে বাঁশির শব্দ শোনা গেছে ময়দানের এ-মাথা থেকে ওমাথা।
এবার বাঁশিটা ওয়েস্ট-কোটের পকেটে রেখে হারুন একটা চিৎকার দিয়ে চমকে দিল ফটিককে।
ছু-ঊ-ঊ-ঊ-ঊ!
ছুছুছুছুছু-ঊ-ঊ-ঊ!
এই এক ডাক আর বাঁশির আওয়াজেই এখান থেকে ওখান থেকে ছেলের দল ছুটে আসতে আরম্ভ করেছে হারুনের দিকে। তারা এসে দাঁড়াতেই হারুন একটা কান-ফাটানো তালি দিয়ে তিনবার পাক খেয়ে একটা ডিগবাজি আর একটা পেল্লায় লাফ দিয়ে তার আশ্চর্য লোক-ডাকার মন্ত্রটা শুরু করে দিল–
ছুছুছুছুছু-ঊ-ঊ-ঊ!
ছু মন্তর যন্তর ফন্তর
হর বিমারি দূর করন্তর
সাত সমন্দর বারা বন্দর
চালিস চুহা ছে ছুছুন্দর
ছু-ঊ-ঊ-ঊ!
ছু বলেই বাঁশিতে আর-একটা লম্বা ফুঁ দিয়ে, আর-একটা তালি আর আর একটা ডিগবাজির পর আবার ধরল হারুনদা
কাম্! কাম্! কান্! কাম!
কাম্-ম্-ম্-ম্-ম্-ম্!
কান্ সি কাম্ সি চমকদারি
হর্ কিস্ম্ কি জাদুকারি
কলকত্তে কি খেল-খিলাড়ি
লম্বি দাড়ি লং সুপারি
কাম্-ম্-ম্-ম্-ম্!
কাম্ কামান্ডর ওয়ান্ডার ওয়ান্ডর
জাগলর জোকার জাম্পিং ওয়ান্ডর
ওয়ান্ডর খালিফ হারুন ওয়ান্ডর
ভেল্কি ভেলকাম্ কাম্ কমাকম
কাম্-ম্-ম্-ম্-ম্-ম্!
কাম-বয় গুডবয় ব্যাডবয় ফ্যাটবয়
হ্যাট-বয় কোটবয় দিস-বয় দ্যাট-বয়
কালিং অলবয়, অলবয় কালিং
কালিং কালিং কালিং কালিং
কাম্-ম্-ম্-ম্-ম্-ম্!
বাপরে, ভাবল ফটিক, কী গলার জোর, কী লোক-ডাকার কায়দা! এরই মধ্যে বেশ লোক জমে গেছে হারুনদাকে ঘিরে। হারুন তার থলি থেকে একটা চকরাবকরা আসন বার করে ঘাসের উপর বিছাল। তারপর তার উপর বসে থলিতে যা কিছু খেলার সরঞ্জাম ছিল, সব একে একে বার করে নিজের দুপাশে সাজিয়ে রাখল।
ফটিক দেখল, চারটে নকশা করা ঝকঝকে পিতলের বল, দুটো প্রকাণ্ড লাটু, তার জন্য মানানসই লেত্তি, তিন-চারটে লাল নীল পালক লাগানো বাঁশের কঞ্চি, পাঁচরকম নকশা করা টুপি–যার একটা হারুনদা মাথায় পরে নিল। ফটিক এতক্ষণ হারুনকে জিনিস সাজিয়ে রাখতে সাহায্য করছিল, এবার হারুন বলল, তুই ভিড়ের মধ্যে গিয়ে দাঁড়া, এক-একটা খেলা যেই শেষ হবে, অমনই তালি দিবি।
প্রথম দুটো খেলার পর ফটিকই তালি শুরু করল, তারপর অন্যরা দিল। তিন নম্বর খেলা থেকে ফটিককে আর ধরিয়ে দেবার দরকার হয়নি। সত্যি বলতে কি, সে হারুনের কাণ্ড-কারখানা দেখে এমন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল যে, তালি দেবার কথা আর মনেই ছিল না। শুধু হাতেরই যে কায়দা, তা তো নয়। হারুনের কোমর থেকে উপরের সমস্ত শরীরটাই যেন জাদু। নমাজ-পড়ার মতো করে গোঁড়ালির উপর বসে অতবড় লাটুটায় দড়ি পেঁচিয়ে সেটাকে সামনের দিকে ছুঁড়ে লেত্তি ফুরোবার ঠিক আগে পিছন দিকে একটা হ্যাঁচকা টান দিলে সেটা যে কী করে শুন্য দিয়ে ঘুরে এসে আবার হারুনদারই হাতের তেলোয় পড়ছিল বারবার ঠিক একই ভাবেই একই জায়গায় পড়ছিল–সেটা ফটিকের মাথায় কিছুতেই ঢুকছিল না। আর সেখানেই তো শেষ না! লাটুটা হাতের তেলো থেকে ওই পালক-লাগানো কাঠির মাথায় বসিয়ে দিল হারুনদা, আর ওই বোমা লাট্টা ঘুরতে লাগল ওই পেনসিলের মতো সরু কাঠিটার মাথায়। ফটিক ভাবল এটাই বুঝি খেলার শেষ, এখানেই বুঝি হাততালি দিতে হবে, কিন্তু ও মা-হারুনদা মাথা চিত করে ঘুরন্ত লাট্ট সমেত কাঠিটা বসিয়ে দিয়েছে। ওর থুতনির ঠিক মাঝখানে! তারপর হাত সরিয়ে নিতে লাটুর সঙ্গে সঙ্গে কাঠিটাও ঘুরতে লাগল থুতনির উপর দাঁড়িয়ে আর সেই সঙ্গে তার গায়ে লাগানো রঙিন পালকগুলো। তারও পরে ফটিক অবাক হয়ে দেখল যে, কাঠিটা আবার মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে ঘুরছে, কিন্তু লাটুটা ঘুরে চলেছে একটানা।