হারুনদা রোজই বিকেলে একবার আসে। উপেনবাবুকে অবিশ্যি আসল ব্যাপার কিছু বলেনি। ফটিক হয়ে গেছে হারুনের দূর সম্পর্কের ভাই, মেদিনীপুরে থাকে, বাপ-মা কেউ নেই, এক খিটখিটে খুড়ো আছে, যে গাঁজা খায় আর ফটিককে ধরে বেধড়ক মারে।–দেখছেন উপেনদা-লোকটা স্রেফ খামচে দিয়ে কনুইয়ের ছাল-চামড়া তুলে দিয়েছে। মাথায় ফোলাটা দেখছেন?–চ্যালাকাঠের বাড়ি। উপেনবাবুও এককথায় রাজি। যে ছেলেটি আছে, তাকে নাকি আর রাখা যাচ্ছে না। সে নাকি পর পর তিন দিন ফাঁকি দিয়ে হিন্দি ফিলিম দেখতে গিয়ে রাত করে ফিরে, ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে বলে দোষ ঢাকতে গিয়েছিল।
ফটিকের চেহারার বদল হয়েছে। তার কোঁকড়া কোঁকড়া চুল কাটিয়ে ছোট করে দিয়েছে হারুনদা। তাতে অবিশ্যি ফটিক কোনও আপত্তি করেনি। চুল ছাঁটার পরে হারুনদা যখন ওকে একজোড়া নতুন হাফপ্যান্ট, দুটো শার্ট, দুটো হাতকাটা গেঞ্জি আর একজোড়া চটি কিনে দিয়ে বলল, কাজের সময় গেঞ্জি পবি, তবে পরার আগে একটু চায়ের জ্বলে চুবিয়ে শুকিয়ে নিবি–তখন ফটিকের হঠাৎ কেন যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। বোধহয় কাজ কথাটা শুনে নিজেকে বড় মনে হওয়ার জন্যেই। কাজটা তার অভ্যেস হয়ে যাবে এটা ফটিক জানে। সকাল সাড়ে-আটটা থেকে রাত আটটা অবধি হপ্তায় পাঁচ দিন। শনিবার চারটে অবধি, আর রবিবার ছুটি। দোকানের পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে উপেনবাবুর ছোট কাঠের ঘর, আর সেই ঘরের দরজার বাইরে টিনের ছাউনির তলায় ফটিকের নিজের শোবার জায়গা। প্রথম রাত মশার কামড়ে ঘুম হয়নি, তাই চাদরটা পা থেকে মাথা অবধি জড়িয়ে নিয়েছিল, কিন্তু নিশ্বাসের কষ্ট হওয়াতে বেশিক্ষণ সেভাবে থাকতে পারেনি। পরদিন উপেনবাবুকে বলাতে উনি একটা মশারি এনে দিলেন। তারপর থেকে ঘুম ভালই হচ্ছে। কনুইয়ের ঘা-টা শুকিয়ে এসেছে, মাথার ব্যথাটা মাঝে মাঝে চলে যায়, আবার মাঝে মাঝে ফিরে আসে। যেটা একেবারেই ফিরে আসে না, সেটা হল–সে দিন সেই আকাশে তারা দেখার আগের ঘটনাগুলো। ও বুঝেছে, ও নিয়ে ভেবে কোনও লাভ নেই। হারুনদাও বলেছে যে, যে-জিনিসটা নেই, যেটা শুন্যি, সেটা নিয়ে ভাবা যায় না। মনে পড়লে আপনিই পড়বে রে ফটিক!
আসল মজা হয়েছিল গতকাল। গতকাল ছিল রবিবার। হারুনদা বলে দিয়েছিল, তাই ফটিক দোকানেই ছিল। হারুনদা এল দুটোর সময়, সঙ্গে কাঁধে ঝোলানো একটা থলি। অনেক রঙচঙে কাপড়ের টুকরো পাশাপাশি সেলাই করে তৈরি হয়েছে থলিটা। ফটিক হারুনের সঙ্গে উপেনবাবুর দোকান থেকে বেরিয়ে দশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিল শহিদ মিনার।
এরকম যে একটা জায়গা থাকতে পারে, সেটা ফটিক ভাবতেই পারেনি। মিনারের একটা দিকে মানুষ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। এত মানুষ এক জায়গায় একসঙ্গে কী করতে পারে, সেটা ফটিকের মাথায় ঢুকল না। হারুন বলল, মিনারের চুড়োয় যদি উঠতে পারতিস–তা হলে দেখতিস, এই ভিড়টার মধ্যে একটা নকশা আছে। দেখতিস ভিড়ের মাঝে মাঝে এক-একটা গোল চক্করের মতো ফাঁকা জায়গা। সেই ফাঁকটার প্রত্যেকটাতে একটা কিছু ঘটছে, আর সেইটে দেখবার জন্য গোল হয়ে লোক দাঁড়িয়েছে।
রোজ এত লোকের ভিড় হয় এখানে? ফটিক জিজ্ঞেস করল।
ওনলি সানডে, বলল হারুন, চ তোকে দেখাচ্ছি। দেখলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবি।
ফটিক দেখল বটে, কিন্তু বুঝল বললে একটু বেশি বলা হবে। এত বিরাট ব্যাপার সহজে বোঝা যায় না। এরকম কাজ, এত রকম খেলা, এতরকম ভাষা, এতরকম রঙ আর এতরকম শব্দ এক জায়গায় এসে জড়ো হয়েছে যে, ফটিকের চোখ-কান-মাথা সব একসঙ্গে ধাঁধিয়ে গেল। শুধু যে খেলা হচ্ছে, তা তো নয়। একটা দিকে কেবল জিনিস ফেরি হচ্ছে–দাঁতের মাজন, দাদের মলম, বাতের ওষুধ, চোখের ওষুধ, নাম-না-জানা শুকিয়ে যাওয়া শেকড়-বাকড়, আরও কত কী। এক জায়গায় একটা টিয়াপাখি একগোছ কাগজের মধ্য থেকে একটা করে কাগজ ঠোঁট দিয়ে টেনে বার করে লোকের ভাগ্য বলে দিচ্ছে। একজন লোক কথার তুবড়ি ছেড়ে এক রকম আশ্চর্য সাবানের তারিফ করছে–লোকটার মাথায় পাগড়ি, গায়ে খাকি প্যান্ট আর দু-হাতে গোলাপি সাবানের ফেনা। একদিকে একটা লোক গলায় একটা ইয়া মোটা লোহার শিকল ঝুলিয়ে হাত-পা নেড়ে কী যেন বলছে, আর তার চারদিকের লোক হাঁ করে তার কথা শুনছে। তার কাছেই একটা সিমেন্ট-বাঁধানো জায়গার উপর পা ছড়িয়ে বসে একটা ভীষণ ময়লা কাপড়-পরা কুচকুচে কালো ঝাঁকড়া-চুলো পাগলা-গোছের লোক লাল, কালো আর সাদা খড়ি দিয়ে আশ্চর্য সুন্দর দেব-দেবীর ছবি। আঁকছে। লোক চারপাশ থেকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে পয়সা ফেলছে, সেগুলো ঠং ঠং করে হনুমানের ল্যাজে, রামচন্দ্রের মুকুটে, রাবণের মাথার উপর পড়ছে, কিন্তু লোকটা সেগুলোর দিকে দেখছেই না।
তবে এটা ফটিক দেখল যে, যেসব জিনিস হচ্ছে তার মধ্যে খেলাটাই সবচেয়ে বেশি। কেবল একটা জিনিসকে ফটিক খেলা বলবে না কী বলবে ভেবেই পেল না–ফটিকের চেয়েও কয়েক বছরের ছোট একটি ছেলে মাটিতে একটা গর্ত খুঁড়ে তার মধ্যে নিজের মাথাটা ঢুকিয়ে দিয়েছে। আর মাথার চার পাশে মাটি চাপা দিয়ে বাতাস ঢোকার ফাঁকটাও বন্ধ করে দিয়েছে আর-একটি বাচ্চা ছেলে। এইভাবে ছেলেটা চিত হয়ে পড়ে আছে তো পড়েই আছে। ফটিক কিছুক্ষণ দেখে তোক গিলে বলল, ও হারুনদা, ও যে মরে যাবে!