বুড়ো কোনদিকে চাইবে বুঝতে পারছে না। পাঁজির পাতা থেকে ধোঁয়া উঠতে থাকে ঘরটার কড়িবরগার দিকে, পাতায় কালশিটে পড়ে গর্ত হয়ে যাচ্ছে, তামাকের গন্ধের সঙ্গে পোড়া কাগজের গন্ধ মিশে যাচ্ছে।
স্যামসন তার ঝাঁঝালো ফিসফিসে গলায় বলে চলল, সেদিন যে এলুম–এসে বললুম একটা বড় কাজে হাত দিতে যাচ্ছি, একটা ভাল দিন দেখে দাও। তুমি বই দেখে হিসেব করে বললে, আষাঢ়ের সাতুই। লোকে বলে, বাড়ির আলসেতে কাগ এসে বসলে ভৈরব ভটচায় তার ভাগ্য গুনে দিতে পারে। আমরাও বিশ্বাস করে এলুম, তুমি বলে-টলে গাঁট থেকে দশটি টাকা বার করে নিয়ে তোমার ওই কাঠের বাক্সের মধ্যে খুঁজে রেখে দিলে। তারপর কী হয়েছে জানো?
গনকার মশাই পাঁজি থেকে চোখ সরাতে পারছেন না বলেই বোধহয় রঘুনাথ লোকটি তাঁর থুতনি ধরে মুখটা ঘুরিয়ে স্যামসনের দিকে করে দিল। আর সেইসঙ্গে দুটো চোখের পাতাও আঙুল দিয়ে টেনে খুলে রাখল, যাতে ভট্টচার্য মশাই স্যামসনের মুখ থেকে চোখ সরাতে না পারেন।
চোখের ব্যাপারটা করার আগে অবিশ্যি ভটচাযের চশমাটি খুলে তক্তপোশের উপর ফেলে দিয়েছিল রঘুনাথ।
বলছি শোনো, বলল স্যামসন, যে গাড়িতে করে মাল নিয়ে যাচ্ছিলাম, এক শালা লরি তাতে মারে ধাক্কা। গাড়ি খোলামকুচি। লরি ভাগলওয়া। দো পার্টনার খতম। স্পট ডেড। আমার লোহার শরীর, তাই জানে বেঁচে গেছি। তাও মালাইচাকি ডিসলোকেট হতে হতে হয়নি। আর এই যে–এ আমার পার্টনার-এর তিন জায়গা জখম, ডান পাশে ফিরে ঘুমুতে পারছে না! ওদিকে যার জন্য এত মেহনত–সে মালটিও খতম।…এসব তুমি গুনে পাওনি কেন?
আমরা তো বাবা ভগবান—
চ্যাওপ!
রঘুনার বুড়োর মাথাটা ছেড়ে তাকে খানিকটা রেহাই দিল, কারণ বাকি খেলাটা স্যামসন একাই খেলবে।
এবার বার করো তো দেখি দাদু দশ ইনটু দশ।
আ-আমি—
চ্যাওপ!
স্যামসনের চাপা চিৎকারের সঙ্গেই তার হাতে একটা ছুরি এসে গেল, আর তার ভাঁজ করা অদৃশ্য ফলাটা হাতলে একটা বোম টেপার ফলে সড়াৎ শব্দে খুলে গেল।
ছুরি-সমেত হাতটা গনকারের দিকে এগিয়ে এল।
দিচ্ছি বাবা, দিচ্ছি বাবা, দিচ্ছি। ভৈরব জ্যোতিষীর থরথরে হাত প্রথমে তার ট্যাঁক, তারপর তার তেলচিটে-পড়া কাঠের ক্যাশবাক্সটার দিকে এগিয়ে গেল।
০৬. এই পাঁচ দিনে ফটিক
এই পাঁচ দিনে ফটিক তার কাজ বেশ কিছুটা শিখে নিয়েছে। উপেনবাবু লোক ভাল হওয়াতে অবিশ্যি খুব সুবিধে হয়েছে। তিনি ফটিককে বারো টাকা মাইনে, থাকার জায়গা, আর খেতে দেবেন। এক মাসের মাইনে আগাম দিয়েছেন। উপেনবাবু যে লোক ভাল, সেটা ফটিক সত্যি করে বুঝেছে গতকাল। কাছেই একটা পানের দোকান থেকে উপেনবাবুর জন্য পান আনতে গিয়ে বিশু নামে আর একটা পানের দোকানের ছেলের সঙ্গে ফটিকের আলাপ হয়। বিশুও সবে মাসখানেক হল কাজে ঢুকেছে। ঢোকার দুদিনের মধ্যে সে একটা চায়ের কাপ ভাঙে, আর সঙ্গে সঙ্গে তার মাথার একগোছা চুল মালিক বেণীবাবুর হাতে উঠে আসে, আর তারপরেই এক রাবুণে গাঁট্টার চোটে মাথায় আলু বেরিয়ে যায়। উপেনবাবু মারেন না। তিনি ধমক দেন, আর ধমকটা অনেকক্ষণ ধরে চলতে থাকে, আর ক্রমে সেটা বদলে গিয়ে একঘেয়ে উপদেশ হয়ে যায়। এই উপদেশটা খেপে খেপে দিনের শেষ অবধি চলতে থাকে। দ্বিতীয় দিনে ফটিক যখন কাঁচের গেলাসটা ভাঙল, তখন উপেনবাবু প্রথমে মেঝেতে ভাঙা টুকরোগুলোর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর ফটিক যখন টুকরোগুলো গামছায় তুলছে, তখন তিনি মুখ খুললেন
কাঁচের জিনিসটা যে ভাঙলে, কিনতে পয়সা লাগে না? পয়সাটা দিচ্ছে কে? তুমি না আমি? এসব কথাগুলো কাজের সময় খেয়াল রেখো। কাজে ফুর্তি চাই ঠিকই, তার মানে এই নয় যে, হাতে গেলাস নিয়ে লাফাতে হবে। দোকানের জিনিসপত্তর হাতে নিয়ে ভোজবাজি করার জিনিস নয়।
উপদেশের কথাগুলো যে উপেনবাবু ঠিক শোনাবার জন্য বলেন, তা নয়। দোকানের গোলমালের মধ্যেই ফটিক লক্ষ করেছিল ওঁর ভুরু কুচকানো আর ঠোঁট দুটো নড়ছে। খদ্দেরের অডার নিয়ে ওদিকে যেতে ওঁর দু-একটা কথা ফটিকের কানে এসে গেছিল। উপদেশ দেবার সময় উপেনবাবু কাজ থামান না, এটা ফটিক লক্ষ করেছে।
দোকানে নতুন মুখ যে রোজ দেখা যায়, তা নয়। বেশিরভাগই যারা আসে তারা রোজই আসে, আর তাদের খাবার সময়টা বাঁধা। শুধু সময় না, অডারটাও বাঁধা। কেউ শুধু চা, কেউ চা-টোস্ট, কেউ চা-ডিম-টোস্ট–এইরকম আর কি। ডিম মানে হয় ডিম পোচ, না-হয় ডিমের মামলেট। কে কী অডার দেয়, সেটা ফটিক এর মধ্যেই বুঝে ফেলতে শুরু করেছে। আজ সকালে সেই রোগা লিকলিকে লোকটা–যে ভীষণ দুঃখ-দুঃখ মুখ করে থাকে–সে এসে তিন নম্বর টেবিলে বসতেই ফটিক তার কাছে গিয়ে বলল, চা আর মাখন-ছাড়া টোস্ট? লোকটা সেইরকমই দুঃখ-দুঃখ মুখ করে বলল, চিনে ফেলেছিস এর মধ্যেই?
লোক চিনে রাখার মধ্যে ফটিক একটা বেশ মজা পেয়ে গেছে। তবে একটু সাবধানে চলতে হবে, কারণ আজই দুপুরে ও একটা ভুল করে বসেছিল। একজন হলদে শার্ট-পরা মোটা লোককে দেখে চেনা মনে করে যেই বলেছে, চা আর ডবল ডিমের মামলেট?–অমনই লোকটা হাতের খবরের কাগজ সরিয়ে ফটিকের দিকে ভুরু তুলে বলল, তোর মর্জিমাফিক খেতে হবে নাকি?
যেটা ফটিকের সবচেয়ে ভাল লাগছে সেটা হল যে, কাপ-ডিশ নিয়ে চলাফেরাটা ওর ক্রমে সহজ হয়ে আসছে। হারুনদা বলেছিল, দেখবি, এসব আস্তে আস্তে কেমন সড়গড় হয়ে আসবে। তখন দেখবি, কাজটা একেবারে নাচের ছকে বাঁধা হয়ে গেছে। আসলে এটাও একটা আর্ট। সেই আর্টটা যদ্দিন রপ্ত না হচ্ছে, তদ্দিন মাঝে মাঝে দু-একটা করে জিনিসপত্তর ভাঙবেই।