ও বলল। সব বলল। ওর মনে হল, একে বলা যায়। এ লোকটা ক্ষতি করবে না ওর, ওকে পুলিশে দেবে না। আকাশে তারা দেখা থেকে আরম্ভ করে বাথরুমের পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সব বলল।
লোকটা শুনে-টুনে কিছুক্ষণ চুপ করে জানালা দিয়ে বাইরের চলন্ত মাঠঘাটের দিকে চেয়ে ভাবল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, তোমার তো তা হলে একটা ডেরা লাগবে কলকাতায়। আমি যেখানে থাকি, সেখানে তো তোমার থাকা পোষাবে না।
তুমি কলকাতায় থাকো?
আগে থেকেছি। এখন আবার থাকব। ডেরা একটা আছে আমার এন্টালিতে। মাঝে-মধ্যে এদিক-সেদিক ঘুরতে বেরোই বাক্স নিয়ে। রথের মেলা, চড়কের মেলা, শিবরাত্তিরের মেলা। বিয়ে-শাদিতেও বায়না জুটে যায় টাইম টু টাইম। এখন আসছি কোয়েম্বাটোর থেকে। কোয়েম্বাটোর জানো? মাদ্রাজে। তিন হপ্তা স্রেফ ইডলি-দোসা। এক সাকাস কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে এসেছি। ভেঙ্কটেশ ট্রাপিজ দেখায় গ্রেট ডায়মন্ডে, আমার সঙ্গে দোস্তি হয়েছে। বলেছে চান্স হলেই জানাবে। আপাতত কলকাতা। শহিদ মিনারের নীচে ঘাসের উপর একফালি জায়গা, ব্যস্।
তুমি ঘাসের উপর থাকবে? ও জিজ্ঞেস করল। ও নিজে অনেকক্ষণ ঘাসের উপর শুয়ে ছিল, সেটা ওর মনে আছে।
লোকটা বলল, থাকব না, খেল দেখাব। ওই যে বেঞ্চির নীচে বাক্সটা দেখছ, ওর মধ্যে আমার খেলার জিনিস আছে। জাগলিং-এর খেলা। একটি জিনিসও আমার নিজের কেনা নয়। সব ওস্তাদের দেওয়া।–ওস্তাদ কথাটা বলেই লোকটা তিনবার কপালে হাত ঠেকাল। –তিয়াত্তর বছর বয়স অবধি খেল দেখিয়েছিল। তখনও চিরুনি দিয়ে দু ভাগ করে আঁচড়ানো দাড়ির অর্ধেক কাঁচা। নমাজ পড়ার মতো করে বসে লাটু ছুঁড়েছে আকাশে, তারপর তেলোটা চিত করে হাতটা বাড়িয়েছে ধরবে বলে হঠাৎ দেখি, ওস্তাদ হাত টেনে নিয়ে দু হাত দিয়ে বুক চেপে দুমড়ে গেল। লাটু আকাশ থেকে নেমে এসে ওস্তাদের পিঠের দুই পাখনার মধ্যিখানে শিরদাঁড়ার উপর পড়ে ঘুরতে লাগল–পাবলিক ক্ল্যাপ দিচ্ছে, ভাবছে বুঝি নতুন খেলা কিন্তু ওস্তাদ আর সোজা হল না।
লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে জানলার বাইরে চেয়ে থেকে বোধহয় ওস্তাদের কথাই ভাবল। তারপর বলল, উপেনদাকে বলে দেখব, যদি তোমার একটা হিল্লে করে দিতে পারেন। অবিশ্যি পুলিশ লাগবে তোমার পেছনে, সেটা বলে দিলাম।
ওর মুখ আবার শুকিয়ে গেল। লোকটা বলল, নিয়মমতো তোমাকে আমার পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া উচিত।
না-না!–ও এবার বেশ জোরের সঙ্গে বলে উঠল।
ভয় নেই, লোকটা একটু হেসে বলল, আর্টিস্টের নিয়মগুলো একটু আলাদা। নিয়ম যদি মানতাম গোড়া থেকেই, তা হলে তোমার সঙ্গে আজ এইভাবে থার্ড কেলাসে বসে কথা বলতে হত না। নিয়ম মানলে এই আপিস ভাঙার টাইমে অরুণ মুস্তাফি হয়তো ফিয়াট গাড়ি হাঁকিয়ে বি বি ডি বাগ থেকে বালিগঞ্জে ফিরত।
একটা লোকের নাম ওর মাথায় ঘুরছিল। ও জিজ্ঞেস করল, উপেনদা কে?
লোকটা বলল, উপেনদা হল উপেন গুঁই। বেনটিং ইস্ট্রিটে চায়ের দোকান আছে।
হিল্লে কাকে বলে?
হিল্লে মানে গতি। যাকে বলে ব্যবস্থা। –তুমি নিঘ্ঘাৎ সাহেব ইস্কুলে পড়েছ।
০৪. দারোগা দীনেশ চন্দ
দারোগা দীনেশ চন্দ আর একবার রুমালটা বার করে কপালের ঘামটা মুছে একটা কেঠো হাসি হেসে বললেন, আপনি অতটা ইয়ে হবেন না স্যার। আমরা তো অনুসন্ধান চালিয়েই যাচ্ছি। আমরা
মুণ্ডু!–হেঁকে উঠলেন মিস্টার সান্যাল। আমার ছেলে কী অবস্থায় আছে সেটাই বলতে পারছেন না আপনারা!
মানে, ব্যাপারটা—
আপনি থামুন। আমাকে বলতে দিন। আমি আপনাদের কথাই বলছি। –চারজন লোক, এ গ্যাঙ অফ ফোর, বাবলুকে কিডন্যাপ করেছিল। তারা একটা নীল রঙের চোরাই অ্যামবাসাডরে করে ওকে নিয়ে ঘাটশিলা ছাড়িয়ে সিংভূমের দিকে যাচ্ছিল।
ইয়েস স্যার।
ইয়েস স্যার, ইয়েস স্যার করার দরকার নেই, আমাকে শেষ করতে দিন।…পথে একটা লরি ওদের গাড়িতে ধাক্কা মেরে পালায়। মাঝরাত্তিরে। লরিটাকে পরে আপনারা ধরেছেন।
ইয়েস দারোগা সাহেব স্যারের আগে ব্রেক কষে নিজেকে কোনওমতে সামলে নিলেন।
অ্যাকসিডেন্টে দুজন লোক মারা যায়। সেই চারজনের মধ্যে দুজন।
বন্ধু ঘোষ আর নারায়ণ কর্মকার।
কিন্তু দলের পাণ্ডা বেঁচে আছে।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
কী নাম তার?
তার আসল নামটা ঠিক জানা নেই।
চমৎকার।–কী নামে জানেন তাকে?
স্যামসন।
আর অন্যটি?
রঘুনাথ।
এও ছদ্মনাম?
হতে পারে।
যাকগে।…স্যামসন আর রঘুনাথ বলছেন বেঁচে আছে–অ্যাকসিডেন্টের পরে তারা পালায়। আর আপনারা বলছেন, বাবলু গাড়ি থেকে ছিটকে বাইরে পড়ে।–
আজ্ঞে, দশ বারো বছরের ছেলের সাইজের একটা জুতোর সোলের খানিকটা পাওয়া গেছে গাড়ি থেকে সাত হাত দুরে। রাস্তার পাশটা খানিকটা ঢালু হয়ে জঙ্গলের দিকে নেমে গেছে, সেই স্লোপের নীচের দিকে। তা ছাড়া রক্তের দাগও পাওয়া গেছে তার আশেপাশে। আর একটি নতুন ক্যাডবেরি চকোলেটের প্যাকেট।
কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি।
না স্যার।
জঙ্গলের ভিতর সার্চ করা হয়েছে? না কি বাঘের ভয়ে সেটা বাদ গেছে?
দারোগাবাবু হালকাভাবে হাসতে গিয়ে না পেরে কেশে বললেন, ও জঙ্গলে বাঘ নেই স্যার। জঙ্গলে তো সার্চ করেইছি, এমনকী কাছাকাছির গ্রামকটাও বাদ দিইনি।
তা হলে আপনারা কী রিপোর্ট করতে এসেছেন আমার কাছে? সমস্ত ব্যাপারটা তো জলের মতো পরিষ্কার। স্যামসন আর রঘুনাথ বাবলুকে নিয়েই পালিয়েছে।