লোকটা দরজার দিকে এগিয়ে এল। মিস্টার সান্যাল রজনীবাবুর দিকে ফিরে বললেন, দারোয়ানকে বলে দিন, বাচ্চা ছেলে সঙ্গে করে কেউ এলে যেন ঢুকতে না দেয়। বলুন, যেন বলে দেয় যে, ছেলে ফিরে এসেছে।
রজনীবাবু হুকুম তামিল করতে চলে গেলেন। পরদা ফাঁক হতেই মিস্টার সান্যাল দেখলেন যে, লোকটা দরজার মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।
একে ভদ্রলোক বলা যায় কি? মিস্টার সান্যাল ভেবে স্থির করলেন–না, যায় না। শার্টটা সস্তা এবং ময়লা, পায়ের চটিটা ক্ষয়ে গেছে, সাদা সুতির প্যান্টটায় অজস্র ভাঁজ। আর ওরকম চুল আর ঝুলপি–অবশ্য না, ওগুলোকে অভদ্র বলা মুশকিল, কারণ তার নিজের সেজো ছেলে প্রীতীন্দ্রর চুল আর ঝুলপিও তো কতকটা ওইরকমই।
ভেতরে এসো।
হারুন চৌকাঠ পেরিয়ে এল।
কী নাম তোমার?
ও হারুনদা, বাবা। আর্টিস্ট। দারুণ খেলা দেখায়।
শরদিন্দু সান্যাল তাঁর সদ্য-ফিরে-পাওয়া ছেলের দিকে একটু বিরক্তভাবেই চেয়ে বললেন, তুমি থামো বাবলু। ওকে বলতে দাও। তুমি বরং ওপরে যাও। ঠামাকে গিয়ে বলল, তুমি ফিরে এসেছ–বড় কষ্ট পেয়েছেন এ কটা দিন। আর ছোড়দাও আছে। ঘুমোচ্ছে। ওকে তুলে দাও গিয়ে।
বাবলুর কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যাবার ইচ্ছে নেই। হারুনদাকে ফেলে সে যাবে কী করে? ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে বাবার চোখের আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বাবলু। ও হারুনদাকে দেখতে পাচ্ছে। ওর পিছন দিকটা।
শরদিন্দু সান্যাল আবার লোকটার দিকে চাইলেন।
শুনি তোমার ব্যাপার।
ও খড়্গপুর থেকে আমার সঙ্গে এসেছে। চলন্ত ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করছিল। আমি টেনে তুলি। তারপর থেকে এখানেই ছিল।
এখানে মানে?
কলকাতায় বেনটিং ইস্ট্রিটে। একটা চায়ের দোকানে।
চায়ের দোকানে? মিস্টার সান্যালের চোখ কপালে উঠে গেছে। কী করছিল চায়ের দাকানে?
কাজ করছিল স্যার?
কাজ? কী কাজ? মিস্টার সান্যাল যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করছেন না।
হারুন বলল। মিস্টার সান্যালের মাথায় চুল প্রায় নেই বললেই চলে, থাকলে বোধহয় বেশ কয়েক গাছা ছিঁড়ে ফেলতেন।
হোয়াট ইজ অল দিস! চেয়ার ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠলেন মিস্টার সান্যাল–এ কি মগের মুল্লুক নাকি? ওকে দিয়ে চায়ের দোকানের বয়ের কাজ করিয়েছ? তোমার কাণ্ডজ্ঞান নেই? দেখে বুঝলে না, ও ভদ্রলোকের ছেলে?
বাবলু আর থাকতে পারল না। ও বারান্দা থেকে দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকে বলল, আমার খুব ভাল লাগছিল কাজ করতে বাবা!
চুপ করো!–গর্জন করে উঠলেন মিস্টার সান্যাল। তোমাকে বললাম না ওপরে যেতে?
বাবলু আবার দরজার বাইরে চলে গেল। অ্যাদ্দিন পরে বাড়িতে ফিরে এসে যে এরকম একটা ব্যাপার হবে, সেটা ও ভাবতেই পারেনি।
হারুন এখনও শান্তভাবেই দাঁড়িয়ে আছে, আর শান্তভাবেই সে বলল, আমি যদি জানতুম ও কোন্ বাড়ির–তা হলে কি আর আমার কাছে রাখতুম স্যার। ও যে বলতে পারলে না। ওর কিছু মনে ছিল না।
আর আজ কাগজে বেরোনোমাত্র সব মনে পড়ে গেল?
মিস্টার সান্যাল যে হারুনের কথা মোটেই বিশ্বাস করছেন না, সেটা তাঁর প্রশ্নের সুর থেকে পরিষ্কার বোঝা গেল। হারুন কথাটা শুনে একটু অবাক হল।
কাগজের কথা কী বলছেন জানি না স্যার। ওর মনে পড়েছে কাল রাত্তিরে। কাল বাদলা ছিল তাই আর আনিনি। আজ নিয়ে এলুম, আপনার হাতে তুলে দিলুমব্যস, আমার ডিউটি ফিনিশ। তবে, ইয়ে, ওর মাথার একটা জায়গায় দেখবেন একটু ফোলা আছে। মাঝে মাঝে ব্যথা হয়। যদি ডাক্তার-ফাক্তার দেখান, তাই জানিয়ে দিলুম।…চলি রে ফটকে।
হারুনদা চলে গেল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাবলু ব্যাপারটা ভাল করে বোঝবার আগেই ওকে বাবা ডাকলেন। বাবলু, একবার এদিকে এসো।
ও এল। টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। শরদিন্দু সান্যাল ছেলের মাথার দিকে হাত বাড়ালেন। কোথায় ফোলা রে?
বাবলু দেখাল। সত্যিই ফোলাটা এখনও পুরোপুরি যায়নি। পাছে ব্যথা লাগে, তাই মিস্টার সান্যাল আর সেখানে হাত দিলেন না।
খুব কষ্ট হয়েছে একদিন?
ও মাথা নাড়ল। না, হয়নি!
ওপরে যাও। হরিনাথকে বলো, গরম জলে বেশ করে চান করিয়ে দেবে। আজ তোমার ছুটি। আজ ডাক্তারবাবু এসে তোমাকে দেখবেন। যদি বলেন যে ঠিক আছে, তা হলে কাল থেকে তুমি আবার ইস্কুলে যাবে। এবার থেকে রোজ গাড়িতে।..যাও।
ও চলে গেল।
মিস্টার সান্যাল সামনে টেবিলের উপর থেকে খবরের কাগজের স্তৃপটা হাতের একটা বিরক্ত ঝাঁটে একপাশে সরিয়ে দিয়ে বললেন, চায়ের দোকান! ফুঃ! তারপর রজনীবাবুর দিকে ফিরে বললেন, চায়ের দোকান! ভাবতে পারো?
রজনীবাবু কেবল একটা কথাই ভাবছিলেন যদিও সেটা তাঁর মনিবকে বলা যায় না, কারণ কথাটা তাঁর সম্পর্কেই। তিনি ভাবছিলেন যে, যে-লোকটা বাবলুকে ফেরত দিয়ে গেল, তার খবরের কাগজ না-দেখার সুযোগটা নিয়ে মিস্টার সানাল তাকে পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করে কাজটা বোধহয় ভাল করলেন না।
ঘণ্টাখানেক পরে মিস্টার সান্যাল দারোগা মিস্টার চন্দর কাছ থেকে একটা ফোন পেলেন।
আপনার বিজ্ঞাপনের কোনও ফল পেলেন? জিজ্ঞেস করলেন দারোগা সাহেব।
উত্তরে মিস্টার সান্যাল যা বললেন তাতে তিনি খুশি তো হলেনই, সঙ্গে সঙ্গে অবাকও হলেন রীতিমতো। বললেন, আশ্চর্য ব্যাপার স্যার!এক-একটা সময় আসে যখন মনে হয়, এগগাবার বুঝি আর রাস্তা নেই। আবার তারপরেই হঠাৎ দেখবেন, ম্যাজিকের মতো সব রাস্তা খুলে গেছে। আপনার ছেলেও ফিরল, আর তার সঙ্গে সঙ্গে সেই গ্যাং-এর দুটি লোকও অ্যারেস্ট হয়ে গেল।