বাঁয়ে ঘুরে চৌরঙ্গি ধরে ট্যাক্সি এগিয়ে চলল ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। সামনে চৌমাথা। ধরমতলার মোড়। বাতি লাল ছিল; ফটিকদের ট্যাক্সি পৌঁছতে না পৌঁছতে সবুজ হয়ে গেল। গাড়ি মোড় পেরিয়ে বিজলি-আপিস বাঁয়ে ফেলে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-এর চওড়া রাস্তা ধরল। রবিবার, তাই ভিড় কম। ফটিক বুঝল, তার কানের পাশ দিয়ে শনশন করে বাতাস বয়ে যাচ্ছে!
আরও জোরে ভাই পিছনে গণ্ডগোল।
হারুনের কথায় ফটিক মাথা ঘুরিয়ে পিছনের কাঁচ দিয়ে দেখল, আর একটা ট্যাক্সির জোড়া আলো। ক্রমে বড় হয়ে তাদের দিকে ধাওয়া করে আসছে।
হারুনদা–ওরা ধরে ফেলবে আমাদের।
না, ফেলবে না। ফটিকের কান বাতাসে বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। জোড়া আলো আবার ছোট হচ্ছে। এবার ঝাঁপসা হয়ে গেল, কারণ কাঁচে বৃষ্টি পড়ছে। ফটিক সামনের দিকে ফিরল। সামনের কাঁচেও বৃষ্টি। সামনেও জোড়া জোড়া গোল আলো একটার পর একটা হুশ হুশ করে ট্যাক্সির পাশ দিয়ে বেরিয়ে উলটো দিকে চলে যাচ্ছে।
এবার একটা জোড়া আলো যেন তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। গাড়ি নয়, বাস। ধুমসো বাস। দৈত্যের মতো বাস। রাক্ষসের মতো বাস। ওই দুটো ওর চোখ। ক্রমে বড় হচ্ছে, বড় হচ্ছে, বড় হচ্ছে। হতে হতে বাসটা হঠাৎ লরি হয়ে গেল। দুপাশের বাড়িগুলো আর নেই…আলোগুলো আর নেই। তার বদলে অন্ধকার, অন্ধকার, অন্ধকার, জঙ্গল, জঙ্গল, জঙ্গল…
কী হল ফটকে? এলিয়ে পড়লি কেন? কী হল?
হারুনের প্রশ্নটা একরাশ ফিরে আসা শব্দের মধ্যে হারিয়ে গেল। প্রথমেই সেই গাড়িতে-গাড়িতে লাগার কান-ফাটা শব্দ–যার পরেই ওর মনে হয়েছিল, ও ঠাণ্ডা হাওয়ায় উড়ছে। সেটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একটা কানে তালা লেগে যাওয়ার ভাব হল, আর তারপরেই তার বারো বছর তিন মাসের জীবনে যা কিছু ঘটেছিল, সব যেন হুড়মুড় করে এসে তাকে ঘিরে ধরে বলল–আমরা এসেছি, যখন চাও, যাকে চাও, বেছে নাও। তারাই বলল, তোমার ভাল নাম নিখিল, ডাকনাম বাবলু, তোমার বাবার নাম শরদিন্দু সান্যাল; তোমার তিন দাদা, এক দিদি; দিদির নাম ছায়া। দিদি বিয়ে করে চলে গেছে বরের সঙ্গে সুইজারল্যান্ড। তারাই বলল, তোমার ঠামা তোমাদের বাড়ির দোতলায় বারান্দার শেষের বাঁ দিকের ঘরটাতে–রাত-দিন পুজোর ঘরে খুটুং খাটুং–নাকের উপর সোনার চশমা এঁটে ইয়া মোটা কাশীরামের ছেঁড়া পাতার উপর ঝুঁকে পড়ে সুর করে দুলে দুলে পড়া ঠামা…ছোড়দা বলল, এই দ্যাখ, ড্রাইভ মারার সময় রিস্ট কী ঘোরে, আর অঙ্কের স্যার মিস্টার শুক্লা বলছে, স্টপ ইট মনমোহন!–মনমোহনের গোল মুখ গোল মাথায় এত সরু বুদ্ধি–যতবার বিক্রমটা পেনসিল কেটে ডেস্কের উপর রাখছে, ও পিছন থেকে কাগজের নল পাকিয়ে ফুঁ দিয়ে সেটাকে গড়িয়ে মাটিতে ফেলে দিচ্ছে। সবচেয়ে হাসি পায় মনে করলে, দিদির বিয়েতে গ্রামোফোনে বিসমিল্লার সানাই, আর পুরনো রেকর্ড ফাটা জায়গায় এসে প্যাঁও প্যাঁও প্যাঁও প্যাঁও প্যাঁও প্যাঁও একই জিনিস বার বার, আর তাই শুনে শামিয়ানার তলায় যত লোক সব খাওয়াটাওয়া ফেলে হো হো হো আর হ্যাঁ, দার্জিলিং তো মনে পড়েই, আর তার আগের বছর পুরী, তার আগে মুসুরি, তার আগে আবার দার্জিলিং, আর তারও অনেক অনেক আগে ছোটবেলায় ওয়ালটেয়ারে সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে পায়ের তলায় বালি সরে সরে যাচ্ছে আর সুড়সুড়ি লাগছে আর মনে হচ্ছে ভিজে ভিজে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লক্ষ লক্ষ পিঁপড়ে সরসর সরসর করে সরে যাচ্ছে, আর মা যেই বললেন, পড়ে যাবে বাবলু সোনা, অমনি ধপাস্ ঝপাং!–মার কথা অবিশ্যি বেশি মনে নেই। এখন খালি একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। এখন বাড়িতে লোক আর নেই। এতবড় বাড়ি আর তিনজন মাত্র লোক। ছোটকাকার তো মাথাই খারাপ। আগে ছিল বাড়িতেই, যখন মাথা ঠিক ছিল। এখন লুম্বিনীতে।….
ও আবার শুনতে পেল ট্যাক্সির শব্দ। বাইরের রাস্তার আলো দেখতে পেল। হারুনদা–হ্যাঁ, ওই তো হারুনদা–ওর পাশের জানলার কাচটা তুলে দিল।
ভয় পেলি নাকি–অ্যাই ফটকে, হারুনদা বলছে। আর ভয় নেই। ওরা আর নেই পেছনে।
ও শুনতে পেল, পাশের বাড়ির রাইট সাহেবদের আলসেশিয়ানটা ভারী গলায় ঘেউ-ঘেউ করছে। কুকুরের নাম ডিউক। ও ডিউককে ভয় পায় না। ওর ভীষণ সাহস। ও রাত্রে একা শোয়। একবার দার্জিলিঙে ও বার্চ হিলের রাস্তা দিয়ে অনেকদূর গিয়ে হঠাৎ কুয়াশা এসে সব ঢেকে দিল। ও তখন একা। ওর মনে আছে, ও ভয় পায়নি।
শরীর খারাপ লাগছে? না মনখারাপ? হারুনদা জিজ্ঞেস করছে।
ও মাথা নাড়ল।
তবে কী? ও হারুনদার দিকে চাইল। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। ট্যাক্সি চলছে এখনও। কাচ তোলা, তাই আস্তে বললেও কথা শোনা যায়। ও আস্তেই বলল–
সব মনে পড়ে গেছে হারুনদা।
১১. চিৎপুরের একটা দোকানে
ওরা দুজন এখন চিৎপুরের একটা দোকানে বসে রুটি-মাংস খাচ্ছে। ও জানে, এরকম জায়গায় এসে ও কোনওদিন খায়নি, হারুনদার সঙ্গে না এলে হয়তো কোনওদিন আসত না। হারুনদা এতক্ষণ ওকে জিজ্ঞেস করে করে সব জেনে নিয়েছে। ইস্কুল থেকে ফেরার সময় লোকগুলো কী করে ওকে রাস্তা থেকে ছিনিয়ে তুলে নিল, তাও বলেছে।
লাউডন স্ট্রিটে তোর বাড়িতে পথ চিনিয়ে নিয়ে যেতে পারবি? হারুন জিজ্ঞেস করল। ও তল্লাট আমার চেনা নেই।
ও হেসে উঠল।–আরেব্বাস, খুব সহজ।