ঠিক হারুনদার মাথার উপরে একটা বল আর-একটা বলের সঙ্গে ধাক্কা লেগে একটা সাত-চড়া কান-ফাটানো শব্দ করে ছিটকে গিয়ে পড়ল দু দিকে ঘাসের উপর।
আরও অবাক এই যে, যে-লোকগুলো এতক্ষণ হারুনকে তারিফ করছিল, তালি দিচ্ছিল, শাবাশ দিচ্ছিল, তারাই হঠাৎ রাক্ষস হয়ে গিয়ে বিকট সুরে হেসে উঠে সেই একই হারুনকে দুয়ো দিতে লাগল।
তাও বেশিক্ষণের জন্য নয়। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ভিড় উধাও হয়ে গিয়ে জায়গাটা খালি হয়ে গেল। এদিকে হারুন নিজেই চোখের বাঁধন খুলে থলির মধ্যে তার খেলার সরঞ্জাম তুলে ফেলেছে। ফটিক পয়সাগুলো তুলতে যাচ্ছিল, হারুন তার দিকে একটা ধমক ছুঁড়ে সেটা বন্ধ করে দিল। তারপর ঘাসের উপর বসেই একটা বিড়ি ধরাল। ফটিক তারপাশে গিয়ে বসল। নিজে থেকে কিছু বলার সাহস নেই তার; সে ইচ্ছেও নেই। চৌরঙ্গি থেকে গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে, যা এর আগের দিন, বা একটুক্ষণ আগে পর্যন্ত ফটিকের কানেই যায়নি। দুটো টান দিয়ে বিড়িটাকে ঘাসের উপর ছুড়ে ফেলে দিয়ে হারুন বলল, মনের সঙ্গে হাতের এমন যোগ না রে ফটিক–একটা গুমসে গেলে। অন্যটাও খেলতে চায় না।…যদ্দিন না তোর একটা হিল্লে হচ্ছে, তদ্দিন ব্লাইন্ড জাগলিং এস্টপ।
এসব আবোল-তাবোল কী বলছে হারুনদা? বেশ তো আছে ফটিক। আবার কী হিল্লের দরকার? হারুন বলে চলল, সেদিন শ্যামলালকে দেখার পর থেকেই তোর ঘটনাটা একটা ছকে এসে গেছে। লোকগুলো তোকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিল। তোকে কোনও একটা গোপন জায়গায় লুকিয়ে রেখে তোর বাবার কাছ থেকে মোটা টাকা আদায় করে তবে তোকে ছাড়ত। ওদের প্ল্যান ভণ্ডুল হয়ে যায় গাড়ির অ্যাকসিডেন্টে। শ্যামলাল আর-আর এক ব্যাটা বেঁচে যায়, অন্য দুটো মরে। তোকে বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকতে দেখে শ্যামলালের হয়তো ধারণা হয়েছিল তুইও মরে গেছিস, তাই তোকে ফেলেই পালায়। তার পর সেদিন উপেনদার দোকানে গিয়ে দেখে, ফসূকে-যাওয়া শিকার আবার হাতের কাছে এসে গেছে।
সেদিন তোকে পৌঁছে বাড়ি ফিরে এসে দেখি, দু ব্যাটা তখনও ঘুরঘুর করছে। এগারোটা পর্যন্ত ছিল, তারপর চলে যায়। আমি পিছনে ধাওয়া করে ওদের ডেরাটা জেনে নিই। পুলিশে বললে ওরা ধরা পড়ে যায়। কিন্তু ওদের ধরিয়ে দিলেই তো আর খেলা ফুরিয়ে যাচ্ছে না।…আমার উচিত তোকেও পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া।
না না, হারুনদা।
জানি। তোর মন আমি জানি। তাই তো কিছু করতে পারছি না। আর সত্যি বলতে কী, তোর পরিচয়টা জানা হয়ে গেলে অন্য কথা ছিল। এখন তোকে পুলিশে দেওয়া আর একটা রাস্তার কুকুরকে পুলিশে দেওয়া একই ব্যাপার।
কথাটা শুনে ফটিকের বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। ও বলল, রাস্তার কুকুর কাঠের বল নিয়ে জাগলিং করতে পারে?
তুই অভ্যেস করছিস? হারুন জিজ্ঞেস করল, এই প্রথম ফটিকের দিকে সোজা তাকিয়ে, এই প্রথম একটু হেসে।
করছি না?–ফটিকের অভিমান এখনও যায়নি। সারাদিন কাজের পর রাত্তিরে ঘুমোনার আগে এক ঘন্টা রোজ। ফটিক পকেট থেকে বল দুটো বার করে হারুনকে দেখিয়ে দিল।
গুড বলল হারুন। দেখি, আর দুটো দিন দেখি। কেউ যদি তোর খোঁজখবর না করে তো তোকে সঙ্গে নিয়েই যাব।
কোথায়?–ফটিক অবাক। হারুনদা যে আবার কোথাও যাবার কথা ভাবছে, সেটা ও এই প্রথম শুনল।
এখনও ঠিক করিনি। কাল সেই ভেঙ্কটেশের একটা চিঠি পেয়েছি। আসতে লিখেছে। এইভাবে মাটি থেকে পয়সা কুড়িয়ে নিতে আর ভাল লাগছে না রে। অনেকদিন তো–
তোমার এই খুদে শাগরেদটি কে হে?
কথাটা এমন আচমকা এল যে, ফটিকের মনে হল, তার কলজেটা এক লাফে গলার কাছে চলে এসেছে।
সেই দুটো লোক অন্ধকারে পিছন থেকে এসে দাঁড়িয়েছে। ফটিকের ডান কাঁধের পাশে এখন শ্যামলালের ধনুকের মতো বাঁকা প্যান্ট-পরা বাঁ পা।
এবার ফটিক দেখল তার কানের পাশ দিয়ে একটা ছুরির ফলা এগিয়ে গিয়ে তার আর হারুনের মাঝখানে এসে থেমে গেল।
হারুনদাও আড়চোখে দেখছে শ্যামলালের দিকে।
রোঘো–চাকতিগুলো তুলে নে। নন্দর দোকানের দেনাটা শোধ হয়ে যাবে।
অন্য লোকটা পয়সাগুলো তুলতে আরম্ভ করে দিল।
কী হে, আমার কথার–
শ্যামলালের কথা শেষ হল না। ফটিক দেখল চারটে পিতলের বল, চারটে ছোরা আর দুটো বোমা লাটু সমেত হারুনদার থলিটা মাটি থেকে হাউইয়ের মতো শুন্যে উঠে গিয়ে, শ্যামলালের থুতনিতে লেগে তাকে পাঁচ হাত পিছনে ছিটকে ফেলে দিল।
ফটকে!
হারুনদার চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে ফটিক দেখল, সে-ও থলিটার মতো শূন্যে উঠে ঝড়ের বেগে এগিয়ে চলেছে হারুনের বগলদাবা হয়ে। এদিকে ধুলোর ঝড় উঠেছে শহিদ মিনারের চারদিকে, আর ময়দানের যত লোক–সব ছুটে চলেছে চৌরঙ্গির দিকে বৃষ্টির প্রথম ঝাঁপটা থেকে রেহাই পাবার জন্য।
ছুটতে পারবি?
পারব।
ফটিক বুঝল তার পায়ের তলায় আবার মাটি, আর বোঝার সঙ্গে সঙ্গেই তার পা-ও চলতে লাগল হারুনের সঙ্গে পা মিলিয়ে গাড়িগুলোর দিকে।
ট্যাক্সি!
একটা ব্রেক কষার শব্দ। ফটিকের সামনে একটা কালো গাড়ির দরজা খুলে গেল।
সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ!
সামনে অন্য গাড়ি, ট্যাক্সি, বাস, স্কুটার। হারুন-ফটিক দৃজনেই পাশ ফিরে দেখছে, শ্যামলাল আর রঘুনাথ দৌড়ে এগিয়ে আসছে ঝড়ের মধ্যে। এখনও দিনের আলো আছে, তবে রাস্তায় আর দোকানে বাতি জ্বলে গেছে।
ট্যাক্সি সামনে ফাঁক পেয়ে রওনা দিল। হারুন ড্রাইভারকে বলল, বাড়তি পয়সা দেব ভাই–একটু তেজ লাগান।