কারা দেখছিল সেই খেলা? ফটিক জিজ্ঞেস করল।
সাহেব, মেমসাহেব, বলল হারুন। ওই উঁচুতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে, আর নীচের দিকে দশ টাকা পাঁচ টাকার করকরে নোট পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে–কেউ সাপের দিকে, কেউ ভাল্লুকের দিকে, কেউ বল খেলার দিকে। বেশিরভাগ বলের দিকেই ছুড়ছে। এক ব্যাটা সাহেবের মাথা মোটা, সে ব্যাটা না-পাকিয়েই ছুঁড়েছে একটা দশ টাকার নোট বলের দিকে, আর দমকা হাওয়া এসে উড়িয়ে নিয়ে সেটাকে ফেলেছে একেবারে ফণা-তোলা গোখরোর ঝাঁপির মধ্যে। ওস্তাদ তখন চোখের বাঁধন খুলে ফেলেছে। সাহেব উপর থেকে চেঁচাচ্ছে, আমি বুলেটের মতো ছুটে গিয়ে ঝাঁপির ভেতর ঘপাৎ করে হাত ঢুকিয়ে নোট বার করে এনে ওস্তাদের হাতে গুঁজে দিলাম। ওস্তাদ শাবাশ বেটা-জিতে রহো বলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। আমি হিন্দি-ফিন্দি জানি না–পকেট থেকে দুটো কাঠের বল বার করে এই তিনদিনে শেখা লোফালুফির খেলা দেখিয়ে দিলাম। ব্যস–সেইদিন থেকে ওঁর দেহ রাখার দিনটা অবধি আমি ওর ছায়ায়। তবু অ্যাদ্দিনেও লোকের সামনে সাহস করে চোখ বেঁধে খেলা দেখাতে পারিনি। আজ সেইটেই একবার চেষ্টা করে দেখব।
বস্তির ছেলে-মেয়ের দল হারুনের দরজার বাইরে অপেক্ষা করছিল। হারুন থলি নিয়ে বেরোল, ফটিক তার পিছনে। বাঁ দিকে ঘুরল হারুন। আট-দশটা ঘর পেরিয়ে একটা খোলা জায়গা, তার পিছনে একটা ডোবা, আর তারও পিছনে একটা কারখানার পাঁচিল। হারুন ডান দিকে খোলা জায়গাটার মধ্যে যেখানটায় জংলাটা কম, সেখানে বসে পড়ল আসন বিছিয়ে। ছেলেমেয়েদের দল তার সামনে আর দুপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
হারুন থলি থেকে বার করল একটা হলদের উপর কালো বুটি দেওয়া সিল্কের রুমাল। সেটা পাশেই দাঁড়ানো ফটিকের হাতে দিয়ে বলল, বাঁধ তো দেখি বেশ করে।
ফটিক রুমালটা দিয়ে হারুনের চোখ বেঁধে, পিছিয়ে ভিড়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
সেই চোখ বাঁধা অবস্থায় হারুন তার গুরুকে তিনবার সেলাম জানিয়ে প্রথমে দুটো আর তারপর তিনটে পিতলের বল নিয়ে এমন আশ্চর্য খেলা দেখাল যে, ফটিকের মনে হল, তার মন থেকে যদি আবার সব মুছে গিয়ে শুধু আজকের খেলাটাই থেকে যায়, তা হলে তাই নিয়েই সে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবে।
কিন্তু বলেই শেষ না। বল রেখে এবার বাঁধন না খুলেই হারুন থলি থেকে বার করল তিনটে ছুরি, যার আয়নার মতো ঝকঝকে ফলাগুলোতে বাড়ি-ঘর-গাছ-আকাশ সবকিছু দেখা যাচ্ছে। ওই ফলাগুলো এবার নাচতে শুরু করল হারুনের হাতে। হারুনের সামনের আকাশ বাতাস চিরে ফালাফালা হয়ে গেল, কিন্তু একটিবারও ছুরিগুলো পরস্পরের গায়ে ঠেকল না, একটি বারও হারুনের হাতে একটি আঁচড়ও লাগল না।
বস্তির আকাশ যখন হাততালি আর চিৎকারে ফেটে পড়ছে, তখন ফটিক এগিয়ে গিয়েও হারুনের বাঁধন খুলতে গিয়ে পারল না, কারণ তার হাত কাঁপছে। হারুন বুঝতে পেরে হেসে নিজেই বাঁধন খুলে নিল। তারপর তার সরঞ্জাম থলিতে পুরে বাচ্চাদের দিকে ফিরে বলল, আজকের মতো খেল খতম। তোরা যে যার ঘরে ফিরে যা!
ফটিকের কেন যেন মনে হচ্ছিল, এমন একটা খেলা দেখিয়ে হারুনের মুখে যতটা হাসি-ফুর্তি থাকা উচিত ছিল, ততটা যেন নেই। হয়তো ওস্তাদের কথা মনে পড়ে তার মনটা ভারী হয়ে গেছে।
কিন্তু আসলে তা নয়। ঘরে ফিরে এসে হারুন কারণটা বলল ফটিককে।
দুটো লোক–বুঝলি ফটিক–বে-পাড়ার লোক–দেখিনি কখনও দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিল তোর দিকে। বাঁধন খুলে উঠে দাঁড়াতেই চোখ গেছে আমার। লোক দুটোর ভাবগতিক ভাল লাগল না।
কথাটা বলতেই ফটিকের ধক্ করে সেই দুটো লোকের কথা মনে পড়ে গেল। ও বলল, একজন ষণ্ডা আর একজন রোগা কি?
হ্যাঁ-হ্যাঁ। তুইও দেখলি?
এখন দেখিনি, দুপুরে।
ফটিক বলল দুপুরের ব্যাপারটা। শুনে হারুনের মুখটা থমথমে হয়ে গেল। কানে লোমটা একটু বেশি কী? হারুন জিজ্ঞেস করল। ফটিকের তক্ষুনি মনে পড়ে গেল। হ্যাঁ, সত্যিই তো! সবচেয়ে আগে কানের দিকেই চোখ গিয়েছিল ফটিকের–এখন হারুনদা বলাতে মনে পড়েছে।
শ্যামলাল, চোয়াল শক্ত করে বলল হারুন। ওপরদিকটা ষণ্ডা হলে কী হবে, পা দুখানা ধনুকের মতো বাঁকা। দূর থেকে পা দেখেই সন্দেহ হয়েছিল। দাড়ি ছিল, কামিয়ে ফেলেছে। কানের দাড়িটা আর কামানোর কথা খেয়াল করেনি। বছর কয়েক আগে চিৎপুরের একটা চায়ের দোকানে যেতুম মাঝে মাঝে। সেখানে দেখিছি। চার বন্ধু ছিল। একের নম্বরের
হারুন হঠাৎ থেমে গিয়ে ভুরু কুঁচকে আবার বলল, দুজন লোক মরে পড়েছিল গাড়িতে তাই না?
ফটিক মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। হারুনের মুখ কালো হয়ে গেল। বলল, যা আঁচ করেছিলাম তাই রে ফটিক। তোর বাপের অনেক পয়সা।
বাবা-টাবার কথা বললে ফটিকের মনে কোনও ভাবই জাগে না, তাই ও চুপ করে রইল। হারুন তক্তপোশ ছেড়ে উঠে গিয়ে পশ্চিমের জানলার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে দেখে বলল, এখনও আছে। সিগারেট ধরাল।
বাইরে অন্ধকার হয়ে এসেছে। ফটিকের মনে পড়ল, ওকে বাড়ি ফিরতে হবে। সেই বেনটিং স্ট্রিটে। হারুনদা ওকে পৌঁছে দেবে বলেছে, কিন্তু লোক দুটোর যদি মতলব খারাপ হয়ে থাকে, তা হলে ওদের দুজনেরই মুশকিল হতে পারে।
হারুনদা আবার তক্তপোশে বসে পড়েছে। ওকে এত গম্ভীর কখনও দেখেনি ফটিক। আমার বাড়ি ফেরার কথা ভাবছ? ফটিক জিজ্ঞেস করল।